‘প্রতিদিন চারশ থেকে পাঁচশ পিঠা নিয়ে আসি। সব পিঠা বিক্রি হয়ে যায়। আমি নিজেই পিঠা বানাই, তবে ছেলে ও দুই নাতিও আমাকে সহযোগিতা করে। হাড় কাঁপানো শীতে পিঠার বিক্রিও বেশ ভালো। প্রতিদিন ৪-৫ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করতে পারছি। গরীবের সংসার, পিঠা বিক্রির টাকা দিয়েই চলতাছে। তবে সব সময় পিঠা বিক্রি হয় না, অনেকে ঠিকমতো দামও দেয় না।’- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রাম্যমাণ পিঠা বিক্রেতা ষাটোর্ধ্ব রহিমা বিবি এভাবেই বর্তা২৪.কম’কে কথাগুলো বলছিলেন। তিনি নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশের পাশে পিঠা নিয়ে বসেন।
তীব্র শীত, কনকনে ঠান্ডা, সন্ধ্যা নামতেই কুয়াশার আবরণে ঢাকা পড়ে পুরো ক্যাম্পাস। এ যেন এক শীতের নগর। সোনালী সূর্য অস্ত যেতেই ক্যাম্পাস এক অন্যরকম পরিবেশ ধারণ করে। আর এ ঠাণ্ডা উপভোগ করতে ক্যাম্পাসে চলছে নানা আয়োজন। কেউবা প্রিয়ার কাধেঁ মাথা রেখে করছে আলাপণ আবার দলপাগল অনেকে একজোঁট হয়ে বসিয়েছেন গানের আসর, চলছে কোরাসের পর কোরাস। এর মাঝে পুরো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন যায়গা জুড়ে বসেছে গরম সব পিঠার আয়োজন। সেসব বাহারি পিঠার যে কত নাম। ভাঁপা, চিতই, পাটিসাপটা, নঁকশি, পাকন, তেলের পিঠা প্রভৃতি। পিঠার স্বাদ বাড়াতে রয়েছে নানা ধরণের ভর্তা। রয়েছে মাশরুম, সবজি, মাংসের পিঠাও। ফলে পিঠার মৌ মৌ গন্ধে অনেকেই ছুটে আসছেন ক্যাম্পাসে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে, ছবি চত্বর, লাইব্রেরির সামনে, বটতলা, আলবেরুণী হল, বঙ্গবন্ধু হল, মীর মশাররফ হোসেন হল, প্রীতিলতা হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল ও শেখ হাসিনা হলসংলগ্ন স্থানে বসেছে এসব পিঠার দোকান। পুরোদমে শীত থাকায় জমেও উঠেছে এসব পিঠার দোকানগুলো। আর এসব পিঠা খাওয়ার মাঝে চলছে আড্ডা।
সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ১৬টি ভ্রাম্যমাণ পিঠার দোকান দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, জাবি ক্যাম্পাসে প্রতিদিন প্রায় একলাখ টাকার পিঠা বিক্রি হয়। আর এসব দোকানগুলোর ওপর জীবিকা নির্বাহ করছেন প্রায় ১৫-১৮ পরিবারের শতাধিক মানুষ।
গ্রামে শীতের সকালে উঠানের মিষ্টি রোদে বসে খেঁজুরের গুড় দিয়ে পিঠা খাওয়ার দৃশ্য পরিচিত। তবে এখানে উঠানে বসার সুযোগ না মিললেও আছে বিভিন্ন টং। তবে অনেক জায়গায় পিঠার দোকানের আশপাশে চৌকিও বসানো হয়েছে। সন্ধ্যা নামতেই বাড়তে থাকে ক্রেতাদের ভীড়। এসব দোকানে ক্রেতাদের মধ্যে যেমন শিক্ষার্থীরা আছেন, তেমনি আছেন স্মৃতির টানে ছুটে আসা সাবেক শিক্ষার্থী ও তার পরিবার সদস্যরা। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এখানকার পিঠার স্বাদ নিতে আসেন।
দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা পিস হিসাবে পিঠা বিক্রি করেন। যেমন: তেলে ভাজা পিঠা পাঁচ টাকা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, মাংস পিঠা প্রতিপিস ১০ টাকা আর পাটিসাপটা, নঁকশি পিঠা ১৫ টাকা করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী চৈতি শাহরিন আড্ডাচ্ছলে বলছিলেন, ‘কুয়াশা ঘেরা হিম হিম সকাল কিংবা বিকেলবেলায় খেজুরগুড়ের ভাপা পিঠা কিংবা ঝাল সর্ষেভর্তা দিয়ে চিতই কিংবা নারকেল ভরা পাটিসাপটা-পুলি পিঠা খাওয়া দৃশ্য এখন নেই বললেই চলে। আর জাবি’র শিক্ষার্থীদের জীবনে এই দৃশ্য এখন অনেকটাই অনুপস্থিত। তবে ক্যাম্পাসের মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে পাওয়া যায় মাটির চুলোয় বানানো ভাপা, চিতই, ডিম চিতই, পুলি, পাটিসাপটা, পাকন পিঠা। এসব পিঠার সাথে চলে আড্ডা-গান আর জীবনের গল্পও।’
তিনি আরো বলেন, ‘জীবনের গল্প লেখার টানে ঘরের আদুরে ছেলে-মেয়েরা, যারা প্রতি শীতে পরিবারের সবার সঙ্গে রোদে বসে পিঠে খাওয়ার দিনগুলো ছেড়ে এই জগৎকে আপন করে নেয় তাদের মনের ভেতরের সেই হাহাকারটাকে কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়। এই পিঠেগুলো হয়তো সেই প্রিয় মানুষগুলোর হাতের জাদুভরা হয় না, তবে তীব্র মনখারাপটাকে কমিয়ে দিতে আর স্মৃতিগুলোকে উজ্জ্বল করে নিতে এর তুলনা হয় না।’
তবে এসব ভ্রাম্যমাণ পিঠার দোকান নিয়েও আছে কিছু বিড়ম্বনা। যত্রতত্র ময়লা ফেলা, আগুন জ্বালিয়ে পরিবেশ নষ্ট করাসহ শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন অভিযোগও করেন। এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোর ফলে ক্যাম্পাসের নির্মল পরিবেশ দূর্লভ হয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ আবার এসব পিঠার এবং অন্যান্যে দোকান উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে। আবার নিয়ন্ত্রিতভাবে অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো রাখার পক্ষে অনেকে।