আমাজনের ‘ডার্ক আর্থ’

, ফিচার

মানসুরা চামেলী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2024-01-22 17:20:28

পৃথিবীর বৃহত্তম বনাঞ্চল আমাজন রেইনফরেস্ট। জীববৈচিত্রে ভরপুর এই জঙ্গলকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য। সম্প্রতি এই রেইনফরেস্ট একটি শহর আবিষ্কার হয়েছে। বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ধরনের ভূগর্ভ উন্মোচন করেছে; এখন ব্যবহার হয়ে আসছে।

আমাজনের একবারে গভীরে প্রত্নতত্ত্ববিদ মার্ক রবিনসন। তার হাঁটু পর্যন্ত কাঁদায় ডুবানো। একটি অভিযানে একদল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীর সঙ্গে রবিনসন ব্রাজিলের সীমান্তের কাছে উত্তর-পশ্চিম বলিভিয়ার ইটেনেজের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বনে যান। সেখানে যাওয়া একবারেই সহজ ছিল না। তারা আমাজনের কাছের গ্রাম ভার্সালেস থেকে ১০ ঘণ্টার নৌকা যাত্রা এড়িয়ে ফ্লাইট ধরেছিলেন। পশু প্রাণী এড়াতে তাদের প্লেনকে রানওয়ের পরিবর্তে ঘাসে ঘুরতে হয়েছে। গাছপালার মোটা শিকড় এবং পিঁপড়ার দল মাড়িয়ে ট্রেকিং করে ঘন রেইনফরেস্টে পৌঁছাতে হয়।

আমাজন রেইনফরেস্ট

এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের সিনিয়র অধ্যাপক রবিনসন বলেন, ‘গরম, আর্দ্র ও ভয়ঙ্কর কামড় খেতে খেতে এই পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। তবে এই ভ্রমণ মূল্যবান ছিল। গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশনও বলা যায়। কারণ তারা আমাজনের অন্ধকার পৃথিবী বা ডার্ক আর্থ; অনেকেই আবার বলেন ‘কালো সোনা বা টেরা প্রেটা নামেও পরিচিত’ সেখানে পৌঁছেছিল। আমাজন অববাহিকার এক ধরনের কালো জৈব সার যার মিশ্রণে মাটির উর্বরতা অবিশ্বাস্যভাবে বাড়ে। এখানে চাষের কাজে এই বিশেষ ধরনের মাটি বহুদিন ধরে ব্যবহার করে আসছেন চাষিরা।

কাঠকয়লা-কালো মাটির এই স্তরটি, ৩ দশমিক ৮ মিটার (১২.৫ ফুট) পুরু। মাটির স্তরটি অ্যামাজন অববাহিকা জুড়ে পাওয়া যায়। মাটি অবিশ্বাস্য উর্বর। ক্ষয়প্রাপ্ত জৈব পদার্থ এবং শস্য উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নাইট্রোজেন, পটাসিয়াম এবং ফসফরাসে সমৃদ্ধ।

রেইনফরেস্টের মাটি সাধারণ বালুকাময় মাটি থেকে পাতলা। এটি প্রাকৃতিকভাবে জমা হয়নি। সমৃদ্ধ এই মাটি বিভিন্ন সময়ের ধ্বংসাবশেষ। একটা সময় আদিবাসীরা এই রেইনফরেস্টে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করেছিল।

চলতি জানুয়ারি মাসে, বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন, তারা একটি বিলুপ্তপ্রায় গার্ডেন সিটি পুনরায় আবিষ্কার করেছেন। ইকুয়েডরের আপানো উপত্যকায় রেইনফরেস্টের পাতার নিচে লুকানো ২ হাজার বছর আগের পুরানো শহর। যেখানে প্লাজা, রাস্তা আবিষ্কার করা হয়। এই গার্ডেন সিটি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল তার উর্বর মাটির কারণে। তবে আমাজনের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো তাদের জমির উৎপাদন বাড়াতে এডিই-এর (ADE) উপর নির্ভর করত। সম্প্রতি  জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা মোকাবিলা করে ফসল ফলাতে ইদানিং বিজ্ঞানীরা আদিবাসীদের এই চাষাবাদের পদ্ধতি সমাজকে ফলো করতে বলছেন।

আমাজেনর ডার্ক আর্থ প্রাচীন নিদর্শন

আমাজনের প্রত্যন্ত অঞ্চল ভার্সালেস রেইনফরেস্টের গন্ধ ও শব্দে ঘেরা। রবিসন বলেছেন, অনেক সময় আপনার মনে হবে আপনি আদিম কোন অঞ্চলে আছেন। তবে এমনটা নয়।

‘আমরা গভীরে যাই ততই জানতে পারি। প্রাথমিকভাবে আপনারা মনে হবে এটা গ্রাম নয়; সব জায়গা আমরা দেখেছি- মনে কঠিন একটি ভ্রমণ। আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছি যেখানে আমরা প্রাচীন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাই।

বর্তমান সময়ে পশ্চিমা ঔপনিবেশিকদের বহন করা রোগে আমাজনের অনেক আদিবাসী সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তাদের চাষাবাদের পদ্ধতিতে আজও রেইনফরেস্টকে আকৃতি দিয়ে যাচ্ছে।

বরিনসন বলেন, পুরো আমাজনে আরেকটি জিনিস আমি খুঁজে পাই। তা হলো এডিই (ADE) পদ্ধতিতে চাষাবাদ।

বিজ্ঞানীরা এই মাটির অবিশ্বাস্য উর্বর ক্ষমতার গোপন রহস্য উদঘাটন করার জন্য মাটির পরীক্ষা করে দেখলেন, এই মূল্যবান স্তরটিতে অজৈব উপাদানের শক্তিশালী মিশ্রণ। যার মধ্যে রয়েছে মৃৎশিল্প, বিশেষ হাড়, মুরগির ছাঁট, মানুষের মল, কাঠকয়লা, ছাই এবং মাছের হাড়। এর মধ্যে রয়েছে জৈব পদার্থ যেমন খাদ্য স্ক্র্যাপ, সার। এটি একই সাথে প্রাচীন আবর্জনার ভান্ডার যা রবিনসনের মতো প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই উর্বর মাটি- রেইনফরেস্টকে সমৃদ্ধ করছে। আজও আদিবাসী সম্প্রদায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষাবাদ করে।

বিজ্ঞানী রবিনসনের ভাষায় ‘এটি সত্যিই সোনার খনি’।

এখানে বহু পুরনো জীবাশ্ম বীজ এবং সিরামিক প্রত্নবস্তুর পাশাপাশি, হাজার হাজার বছর আগে রেইনফরেস্ট কেমন ছিল তার মাইক্রোস্কোপিক সূত্র রয়েছে।

আমাজনের অনেক আদিবাসী বহু আগে বিলুপ্ত হয়েছে। তবে তাদের উত্তরাধিকার রয়ে গেছে

জীবন্ত ইতিহাস

১৮৭০ সালে এডিই পদ্ধতিতে প্রথমে আগ্রহ দেখায় পশ্চিমারা। যখন অনেক বিজ্ঞানীরা স্বাধীনভাবে মাটির কালো স্তর নিয়ে পরীক্ষা করেন। তারা দেখেন- মাটির কালো স্তরকে ফ্যাকাশে ও কালচে ধরনের বস্তু ঘিরে রেখেছে। একটি প্রাথমিক ধারণা মতের বর্ণনায় দেখা যায়, সেখানে সুক্ষ্ম, কালো এবং দোঁআশ মাটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে ভারতীয় মৃৎশিল্পের টুকরো পাওয়া যায়, যা মাটিকে প্রায় ঢেকে রাখে।   

যাইহোক, এডিই পদ্ধতিটা অনেকটা রহস্যময়। এই পদ্ধতি দুর্ঘটনাবশত নাকি রেইনফরেস্টকে সমৃদ্ধ ও জমিকে চাষের উপযুক্ত করতে কিনা- সে প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মনেও রয়েছে।

২০২৩ সালে আর্ন্তজাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল বিষয়টি নিয়ে একটি জরিপ করেছেন। তারা মধ্য ব্রাজিলের দক্ষিণ-পূর্ব আমাজনে কুইকুরো-তে বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়কে পর্যবেক্ষণ এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে এটা নিশ্চিত করেছেন যে, এডিই পদ্ধতি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়েছিল।

মাটির বয়স ও তার চরিত্র দেখে বোঝা যায়- আমাজনের প্রাচীন আদিবাসীর ইতিহাস ও উত্থান সম্পর্কে। এই কালো মাটির প্রাচীনতম স্তরগুলো প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরনো। ‘আমরা প্রায় ৪ হাজার বছর আগের আরও অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি।’রবিনসন বলেন। ‘আরও কার্যক্রম, অনেক সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও হয়েছে।’

২ হাজার বছর আগের ঘটনা হবে না, তবে এটি শীর্ষে পৌঁছে যায় বলছেন রবিনসন। এটি কালো মাটির গড় বয়সের বিষয়টি আমাজন অববাহিকা জুড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে পাওয়া যায়। ওই সময় সম্প্রদায়গুলো অনেক বড় ছিল এবং বিশাল নেটওয়ার্ক গঠন করে।

এর একটি কারণ হতে পারে ADE। জঙ্গলের আবাসস্থলে আদিবাসীরা তাদের প্রয়োজনীয় ফলের গাছ এবং ফসল ফলানোর জন্য সমৃদ্ধ মাটি পেয়েছিল। রবিনসন বিশ্বাস করেন, এডিই পদ্ধতি থাকলে বৃহত্তর আকারের কৃষিতে লোকেদের ফিরে আসার কোন প্রয়োজন ছিল না।

৫০০ বছর আগে কিছু বিষয় একবারে ভুল ছিল। ‘যখন আমরা দেখি চাষাবাদে এডিই পদ্ধতি বন্ধ হয়।’ বলেন রবিনসন।

১৪৯৮ সালের ১ আগস্ট ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমিরিকায় পা দেওয়া পর তা আরো প্রতিফলিত হয়।

তিনি যখন ভেনেজুয়েলার পারিয়া উপদ্বীপের মাটিতে স্পেনের লাল এবং গোল্ডেন পতাকা ডুবিয়ে দেয়, তখন এটি একটি "মৃত্যু" এর সূচনা করে। এরপর ১৬০০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা জুড়ে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন আদিবাসি মানুষকে হত্যা করা হয়। যা পৃথিবীকে শান্ত করেছিল।

প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে এখন অনেক কোম্পানি বায়োচার তৈরি করছে

আমাজনের কার্বন সিঙ্ক

আমাজনের অনেক আদিবাসী বহু আগে বিলুপ্ত হয়েছে। তবে তাদের উত্তরাধিকার রয়ে গেছে। আমাজনের মাটি অত্যন্ত উর্বর যাতে মূলত জৈব বর্জ্য জমে এবং এর কার্বনাইজেশনে আগুনের ব্যবহার দ্বারা উদ্ভূত হয়, যা প্রাচীন আদিবাসী মানুষের কাজের ফলাফল।

আশ্চর্যজনকভাবে, তাদের রেখে যাওয়া ADE পদ্ধতি সব জায়গায় একই নয়; বিভিন্ন স্থানে ব্যবহারের উপর ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

‘কিন্তু মাটি তৈরি এবং তাদের সমৃদ্ধ করার জন্য মৌলিক প্রক্রিয়া একই রকম বলে মনে হচ্ছে,’ রবিনসন বলেছেন।

সাম্প্রতিককালে বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রাচীন পদ্ধতিকে পুঁজি করার চেষ্টা করছে। তারা জমির উর্বরতা বাড়াতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কৃষকদের সহায়তা করছে। কার্বন গোল্ড নিন নামে একটি সংস্থা যা জৈব, পিট-মুক্ত রোপণে সহায়তা করতে বায়োচার উৎপাদন করছে।

ভার্সালেস গ্রামে, আদিবাসী ইটোনামা সম্প্রদায় এখনও ফসল ফলানোর জন্য উর্বর আমাজনীয় কালো মাটি ব্যবহার করছে

এসব উদ্যোগ প্রসঙ্গে রবিনসন মনে করেন, আমাজনে প্রাচীন আদিবাসীদের পদ্ধতি অনুলিপি করা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অপরিহার্য। ভবিষ্যদ্বাণীর দিকে ইঙ্গিত করে রবিনসন বলেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে মধ্যে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বাস করবে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় বনে প্রচুর পরিমাণে অভিবাসন হবে।

‘সম্প্রদায়ের জন্য তাদের মধ্যে আরও টেকসই হওয়ার উপায় খুঁজে বের করা, আমি মনে করি এটি অপরিহার্য,’ তিনি মনে করেন। ‘অতীত থেকে আমরা এই বিষয়ে কিছু শিখতে পারি।’

সূত্র: বিবিসি

এ সম্পর্কিত আরও খবর