সংবাদ পরিবেশনে এআই উপস্থাপক—কতটা বিশ্বাসযোগ্য!

, ফিচার

মানসুরা চামেলী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2024-01-27 20:29:47

২২ মিনিট ৩ সেকেন্ড ধরে এডিট করা বিভিন্ন নিউজ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক পড়ে যাচ্ছেন উপস্থাপিকা। কিন্তু তারা কেউ রক্তে মাংসে গড়া মানুষ নন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) প্রেজেন্টার। তবে শুরুতেই বিষয়টি কেউ ধরতে পারবেন না। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটি লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক চ্যানেল ওয়ানের।

গত বছরের শেষের দিকে চ্যানেলটি তাদের এআই-জেনারেটেড সংবাদ পরিবেশনের প্রচারমূলক ভিডিও স্ট্রিমিং করেন। সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন বিশ্বের প্রথম সংবাদ নেটওয়ার্ক এ বছর চালু করতে যাচ্ছে তারা।

প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা অ্যাডাম মোসাম বিষয়টিকে খবর পরিবেশনের আকর্ষণীয় ধাপ বলে মানছেন। তারা মনে করেন, এতে করে দর্শক খবরে নতুন অভিজ্ঞতা পাবে।

এআই প্রযুক্তি এক ভাষা থেকে অন্য ভাষাতে স্ক্রিপ্ট এবং সাক্ষাৎকার অনুবাদ করতে সাহায্য করবে।- এআই এই সক্ষমতা চ্যানেল ওয়ান তার প্রচারমূলক ভিডিওতে প্রদর্শন করে দেখিয়েছে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) মাধ্যমে সংবাদ উপস্থাপনার ধারণাটি বিশ্ববাসীর জন্য ইতোমধ্যেই পুরনো খবর। ২০১৮ সালে চীনের সংবাদ সংস্থা সিনহুয়া সর্বপ্রথম এআই সংবাদ উপস্থাপকের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেয় বিশ্বকে। এরপর অনেক দেশই পরীক্ষামূলকভাবে এআই দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে আসছে। এরপর ২০১৯ সালে লাটভিয়ার টিভি চ্যানেলে দেখা যায় লরা নামক এআই উপস্থাপককে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে কুয়েত নিউজে দেখা মেলে এআই উপস্থাপক ফেদা'র। একই মাসে ভারতীয় সংবাদ চ্যানেল আজ তাক-এর স্ক্রিনে দেখা যায় এআই উপস্থাপক সানাকে। গত বছর ভারতের উড়িষ্যার এক টিভি চ্যানেলেও খবর পড়তে দেখা যায় লিসা নামক এআই উপস্থাপককে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উপস্থাপক।

এআই দিয়ে যা দেখানো হচ্ছে তার সঙ্গে দর্শকরা কি সামাজিক সম্পর্ক বজায় ও এআইর প্রতি ভরসা বজায় রাখতে পারবেন—এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

জনমত পোলিং ফার্ম ইপসোসের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদ উপস্থাপকদের প্রতি মানুষের প্রতি আস্থা সর্বনিম্নে নেমেছে। যুক্তরাজ্যের মাত্র ৪২ শতাংশ মানুষ টিভি নিউজরিডারদের বিশ্বাস করে। যা এক বছরে প্রায় ১৬ শতাংশ কম।

এদিকে, সোশ্যাল মিডিয়ার তারকারা শ্রোতাদের সাথে প্যারা-সামাজিক প্রভাব (একতরফা সম্পর্ক) নামে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। যদিও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদরা ১৯৫০-এর দশকে প্রথম প্যারা-সামাজিক সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। সেই সময় থেকে রাতে সংবাদ পড়া উপস্থাপকরা প্যারা-সামাজিক সম্পর্ক দিয়ে মানুষের আপন হয়ে উঠেছিল। এক পর্যায়ে সংবাদ উপস্থাপকরা সাংবাদিকদের থেকেও বেশি আপন হয়ে ওঠেন। তারা সংবাদ শোনায়; তারা বন্ধু, রাতের পর রাত আপনাকে বসার ঘরে স্বাগত জানায়—বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায়।

এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রভাব বিস্তারকারীরা সরাসরি ক্যামেরা ফরমেটে সংযোগ স্থাপন করছেন। দুর্দান্ত সাফল্যের জন্য মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং লেবার বিভাগের শিক্ষার্থী ক্রিস্টিন এইচ ট্রান বলেছেন, 'প্যারা-সামাজিক' লেবেলটি দিনে দিনে বিবর্তিত হয়েছে। আপনি একজন প্রতিবেদক বা নিউজ টুইচ স্ট্রিমারের সাথে প্যারা-সামাজিক সম্পর্কে থাকতে পারেন।  এছাড়া আপনি একজন ইউটিউবার, একজন গায়ক এবং ‘ইনস্টাগ্রাম-পাওয়ার কাপল’-এর সাথে একটি প্যারা-সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন।

কিন্তু, এআই’র সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ স্থাপনের সম্ভাবনা কম, যতটা আপনার অন্য মানুষের সঙ্গে করা সম্ভব। মানুষ এখানে কোন ধরনের তুলনায় যাবে না। কারণ এটা মনে করা হাস্যকর যে মানুষের চেয়ে রোবট ভালো কাজ করে, বলছেন অ্যাডাম মোসাম।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়টার্স ইন্সটিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম-এর সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এবং বিবিসির সাবেক সম্পাদক নিক নিউম্যান বলেছেন, যখন আমি সাংবাদিকতায় শুরু করলাম, তখন অভিনেতা সংবাদ পড়তেন। মানুষ এটিকে খুব ভালোভাবে নিত।

সাংবাদিকরা সবসময় সংবাদ পড়লেও এই পরীক্ষাটি সফল হতে পারে, বলেন নিউম্যান। এটি শুধুমাত্র সংক্ষেপ সংবাদ বুলেটিনের জন্য উপযোগী হতে পারে, দর্শকরা এআই প্রেজেন্টারের সঙ্গে একটি ‘পরাসামাজিক’ সম্পর্ক তৈরি করবে- এ নিশ্চয়তা একবারেই কম। সংবাদ পরিবেশনের জন্য, আমি মনে করি মানুষই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রাখবে, তিনি বলেন।

চ্যানেল ওয়ান এবং নিউজজিপিটি, যারা নিজেদের সম্পূর্ণরূপে এআই দ্বারা পরিচালিত বিশ্বের প্রথম নিউজ চ্যানেল বলে দাবি করছে;- এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা কী সম্পূর্ণরূপে মানুষের প্রভাব সরিয়ে দিতে পারবে?

বর্তমানে, চ্যানেল ১-এ প্রায় এক ডজন কর্মী এআই তৈরিকৃত স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা, যাচাইবাছাই এবং প্রতিবেদনের বিষয় নির্বাচন করছেন। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৩-ধাপের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে যাতে এআই দ্বারা নির্ভুলভাবে সংবাদ পরিবেশন করা যায়।

বিবিসি নিউজে ১৮ বছর সংবাদ উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা সাংবাদিক সাইমন ম্যাকয় বলেছেন, এআই উপস্থাপক হয়তো খবর পড়তে গিয়ে উচ্চারণে কোনো ভুল করবে না, মেকআপ বা জামা-কাপড় নিয়ে তার কোনো সমস্যা থাকবে না, দিন-রাত বিরতিহীন কাজ করে যাবে, পারিশ্রমিক নিয়ে চিন্তা করবে না। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাই হবে মানবীয় আবেগের অভাব। সংবাদের ধরন অনুযায়ী এআই অবতারের মৌখিক অভিব্যক্তি বদলাবে না। যে কারণে সংবাদকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যর্থ হবে এআই।

সূত্র: বিবিসি

এ সম্পর্কিত আরও খবর