দুপুরে খাওয়ার পরই শরীরে আলস্য দেখা দেয়। ঝিমুনি বা ঘুম ঘুম ভাব কাজের গতি কমিয়ে দেয়। অনেকেই আবার এই সময়টাতে একটু ঘুমিয়ে নেন। আর এটাকেই বলে দুপুরের ‘পাওয়ার ন্যাপ’। অনেক দেশের সংস্কৃতিতে বিকেলে ঘুমানো দৈনন্দিন রীতি। যদিও কেউ কেউ এই ‘পাওয়ার নাপ’ নিতে চান না। কারণ তারা মনে করে এখন ঘুমালে রাতের ঘুমে প্রভাব পড়বে।
বিশেষ করে স্প্যানিশরা প্রতিদিনের সিয়েস্তা (পাওয়ার ন্যাপ) উপভোগ করতে বেশি পরিচিত। জাপানি শ্রমিকরাও দুপুরের খাবারের পর একটু ঘুমিয়ে নিতে অভ্যস্ত। যা হিরুইন ‘বিকালের ঘুম’ নামে পরিচিত।
গুগল, স্যামসাং এবং ফেসবুকের মতো টেক জায়ান্ট অফিসে সকলের জন্য ন্যাপ পড (স্লিপ পড) রয়েছে। ফলে কর্মীরা কাজের ফাঁকে কিছু সময় শুতে পারেন।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ‘পাওয়ার ন্যাপিং’ নেওয়ার দাবিটা বেশ জোরালো হচ্ছে। কিন্তু দিনের বেলা দ্রুত ক্যাটন্যাপ কি আসলে কাজ করে? স্বাস্থ্যের জন্য ‘পাওয়ার ন্যাপ’কতটা উপকারী! পাওয়ার ন্যাপ কি আপনাকে সতেজ এবং উজ্জীবিত রাখে, নাকি বেশি ক্লান্তি বোধ করায়? কতক্ষণ ঘুমানো উচিত? দিনের কোন সময়টা এই ঘুমের জন্য ভালো!
সবশেষ বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা নিয়ে বিবিসির ফিচার বিভাগের করা একটি প্রতিবেদনে ‘পাওয়ার ন্যাপ’ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো কিনা- এসব উত্তর খোঁজা হয়েছে।
ন্যাপিং-এর স্বাস্থ্য উপকারিতা কী কী?
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ন্যাপ নেওয়া মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (ইউসিএল) এবং উরুগুয়ের ইউনিভার্সিটি অফ রিপাবলিকের গবেষকদের ২০২৩ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, অভ্যাসগত ন্যাপ মস্তিষ্ককে বড় এবং এর স্বাস্থ্যকে ভালো রাখতে সাহায্য করে।
প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ; যাদের বয়স ৪০ থেকে ৬৯ বছর; তারা ইউকে বায়োব্যাঙ্ক ও বায়োমেডিকাল ডাটাবেস বিজ্ঞাপন গবেষণা সংস্থার গবেষণায় অংশ নেন। তারা অভ্যাসগত ন্যাপারদের পূর্বের ডিএনএ স্নিপেট পর্যবেক্ষণ করেন।
যারা সপ্তাহে কয়েকবার ন্যাপ নেন, তাদের মস্তিষ্ক যারা কখনওই ন্যাপ নেননি তাদের মস্তিষ্কের তুলনায় ১৫ ঘন সেমি (০.৯ ঘন ইঞ্চি) বেশি বড়।
UCL-এর MRC ইউনিট ফর লাইফলং হেলথ অ্যান্ড এজিং-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, প্রধান লেখক ভিক্টোরিয়া গারফিল্ড বলেন, নিয়মিত ন্যাপ নেওয়া মস্তিষ্ককে বার্ধক্যকে যেতে তিন থেকে ছয় বছর বিলম্বিত করে।
গারফিল্ড আরও বলেন, গবেষণায় বড় মস্তিষ্ক ছিল তাদের, যাারা দিনের বেলা ন্যাপ নেন। এই মস্তিষ্কের কাজের সক্ষমতা ও কার্যকারিতাও বেশি। আমরা জানি বয়স বাড়ার সাথে সাথে মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই সংকুচিত হয়। আর ছোট মস্তিষ্ক নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যাদের মস্তিষ্ক ছোট তাদের স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের উচ্চ মাত্রা বা স্লিপ অ্যাপনিয়া রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অনেকেরই আবার কার্ডিওভাসকুলার রোগ আছে।
এছাড়াও আলঝেইমার্স এবং ভাস্কুলার ডিমেনশিয়াতে মস্তিষ্কের যথেষ্ট সংকোচন দেখতে পাই।– বলেন গারফিল্ড।
তবে মস্তিষ্ক বড় হওয়ার ফলাফল শুধুমাত্র যারা নিয়মিত ন্যাপ নেন তাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এজন্য নিয়মিত ন্যাপ নেওয়াকে জোর দেন এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী।
ন্যাপ নেওয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্য সুবিধাও রয়েছে। পাঁচ থেকে ১৫ মিনিটের ন্যাপের ফলে মানসিকভাবে আমরা ভালো কাজ করতে পারি। এই সামান্য ঘুম তিন ঘণ্টা পর্যন্ত মানসিক প্রশান্তি দেবে।
যুক্তরাজ্যের লাফবোরো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ঘুম বিশেষজ্ঞ কেভিন মরগান বলেছেন, এই মুহূর্তে ক্রীড়া বিজ্ঞানে ঘুম একটি বিশাল ব্যাপার। একজন ক্রীড়াবিদদের পারফরম্যান্সে উন্নত করতে পারে ঘুম।
বর্তমানে কোচরা খেলোয়ারদের ন্যাপ নেওয়ার সময় দেন। তারা এটিকে খাদ্যতালিকার পরিপূরক হিসাবে বিবেচনা করছেন- বলেন মরগান।
গবেষণায় দেখা গেছে, দুপুর একটা থেকে বিকাল চারটার মধ্যে ন্যাপ নিলে শরীর ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মেজাজও ভালো থাকে।
ন্যাপিং কী প্রতিদিনের রুটিন হওয়া উচিত
ন্যাপ নেওয়া যেহেতু শরীরের জন্য ভালো। তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কি প্রতিদিন আমাদের ন্যাপ নেওয়া উচিত?
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ন্যাপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ তবে তা রাতের ঘুমের বিকল্প হতে পারে না।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘুমের ওষুধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কলিন এস্পি বলেছেন, সাধারণত ন্যাপ একটি লক্ষণ যে আপনি পর্যাপ্ত ঘুম পাচ্ছেন না।
‘আপনি যদি মনে করেন আপনার প্রায়ই দিনের বেলা ন্যাপ প্রয়োজন, তাহলে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন আপনি ঘুমের সমস্যার জন্য ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন নাকি আপনার রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারছেন না। সবার আগে আমাদের উচিত রাতের ঘুমটাকে নিশ্চিত করা- বলেছেন এস্পি।
১৫ থেকে ২০ মিনিট স্থায়ী ন্যাপ- মানুষকে গভীর ঘুমে নেয় না। এটি তখন হয় যখন শরীর টিস্যু মেরামত করে এবং পুনরায় পেশী তৈরি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে এবং অনেক আগের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনে এবং নতুন তথ্য মস্তিষ্কে প্রক্রিয়াজাত করে।
ঘুম বিশেষজ্ঞ এস্পি বলেছেন, ঘুম প্রকৃতির ওষুধ। যা আমাদের বিকশিত ও মস্তিষ্কের শক্তির জন্য প্রয়োজন। সেজন্য রাতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।
যে সব মানুষের রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়, সম্ভবত দিনে তারা ন্যাপ নিলে বেশি উপকৃত হবেন। কিন্তু অনেকেই অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে পারেন না। আবার কেউ কেউ দিনের বেলা ন্যাপ নেন না কারণ তারা এটাকে সহজ মনে করে না। তবে ন্যাপ যারা নিতে পারেন- তাদের কাছে এটি একটি সম্পদের মতো- মরগান বলেছেন।
কতক্ষণ ন্যাপ নেওয়া উচিত
কোন সময় ও কতক্ষণ ন্যাপ নেবেন তা বাছাই করাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ! মর্গান বলেন, কেউ যদি ন্যাপ নিতে চায় তাহলে সেটা দুপুরে নিতে হবে এবং ২০ মিনিটের বেশি নেবেন না। দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টার মধ্যে ন্যাপ নেওয়া শরীরের জন্য অনেক ভালো। এই সময় শরীরের তাপমাত্রা কমতে থাকে। যদি সকালে ন্যাপ নিতে চান, তখন শরীরের তাপমাত্রা বাডতে থাকে, এজন্য না নেওয়াটাই ভালো। আবার যদি দিনের শেষে ন্যাপ নেন তাহলে রাতে ঘুমাতে লড়াই করতে হবে। ২০ মিনিটের বেশি ঘুম হলে গভীর ঘুমে চলে যেতে হবে। তখন জড়তা তৈরি হবে। জাগানো কঠিন হবে।
মর্গান বলেন, ঘুম আপনার পছন্দের জিনিস না- এটি একটি অভ্যাস। আপনি যেভাবে অভ্যাস করবেন। মস্তিষ্ক আপনার সাথে সেভাবে চলবে।