ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন 'কোটামন দিঘি'

, ফিচার

ছাইদুর রহমান নাঈম, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট,বার্তা ২৪.কম, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) | 2024-02-14 10:00:54

স্ত্রী কোটামন রায় বিবিকে অনেক ভালোবাসতেন সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়। নিজের সহধর্মিণীর প্রতি অগাধ প্রেম ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে খনন করেন বিশাল এক দিঘি। আজও কোটামন দিঘি ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। স্বচ্ছ পানির দিঘিটি কটিয়াদীর সবচেয়ে মনোরম পর্যটন আকৃষ্ট স্থান।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ সড়কের পাশেই আচমিতা ইউনিয়নের চারিপাড়া গ্রামে পাঁচশ বছরের স্মৃতিবিজড়িত প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত কোটামন দিঘি অবস্থিত। দিঘিতে ঢুকতেই গেট ও পাকা রাস্তা আর সবুজ ঘাসের আবরণ, যা দেখে মুগ্ধ হবে সবাই। নয়নাভিরাম এই দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে আসেন অনেক মানুষ। বর্তমানে সংরক্ষিত এলাকা ও প্রবেশ কড়াকড়ি থাকায় হতাশ পর্যটকরা।

বিভিন্ন তথ্য সূত্র ও স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, জনশ্রুতিতে আছে ষোড়শ শতকে চারিপাড়া সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ের স্ত্রীর নাম ছিল কোটামন রায়। কোটামন রায়ের বড় দিঘিতে স্লান করার ইচ্ছে হলে তা রাজার কাছে ব্যক্ত করেন। স্ত্রীর মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য রাজা নবরঙ্গ রায় ৩০ একর যায়গা নিয়ে বিশাল দিঘি খনন করেন এবং স্ত্রীর নামানুসারেই দিঘিটির নাম রাখেন কোটামন দিঘি।

এই কোটামন দিঘি নিয়ে এখনও লোখমুকে নানান কাহিনী শুনা যায়। দিঘির পানি থেকে থালা, বাসন, কলশী, জগ, গ্লাস, ইত্যাদি দিঘির পাড়ে উঠে আসত। এলাকাবাসী বিয়ে ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতেন কোন এক সময়ে একজন মহিলা ছোট একটি গ্লাস শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে রাখার ইচ্ছে করলে বাকিগুলো আর দিঘির পানিতে নেমে যেতে চাইনি। গ্লাস ফেরত দেওয়ার পর সবগুলো দিঘির জলে চলে যায়। এরপর থেকে এসব থালা, বাসন, জগ, কলশী, গ্লাস ইত্যাদি আর উঠে আসেনি। খাবারের শেষে যথাস্থানে আবার রেখে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।


দিঘিটি নিয়ে দুটি কথা প্রচলন রয়েছে। আরেকটি কথা হচ্ছে, রাজা স্বপ্নে দেখেন এই অঞ্চলে পানির সংকট হয়ে তীব্র খরা দেখা দিতে পারে ৷ পানি সংরক্ষণের জন্য বড় দিঘি খনন করেন। তিনি খুবই প্রতাপশালী ও অত্যাচারী রাজা ছিলেন বলে জানা যায়।

ষোড়শ শতাব্দীতে কিশোরগঞ্জের যশোদল অঞ্চলের রাজা পিতা গোবর্ধন আইনের নামে রাজা নবরঙ্গ রায় আচতিমা গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আচমিতার নিকটবর্তী চারিপাড়া গ্রামে রাজা নবরঙ্গ রায় স্বীয় বাসভবন ও প্রধান শাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত পুঁথিকার মুন্সি আবদুর রহিমের পুঁথিতে এর উল্লেখ আছে।

‘নবরঙ্গ রাজা ছিল যশোদলে বাস আছিল প্রতাপি অতি দেশেতে প্রকাশ। তাহাতে আমির খান সবংশে বদিয়া’ পুঁথির বর্ণনা মতে এবং ঐতিহাসিক কেদারনাথ মঞ্জুমদারের ময়মনসিংহের গ্রন্থে ঈশা খাঁর সমসাময়িক তালুক আমির খাঁ রাজা নবরঙ্গ রায়ের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। যুদ্ধে সপরিবারের রাজা নবরঙ্গ রায় নিহত হন। রাজার ১৩তম বংশধর দীগেন্দ্র রায় চৌধুরীর কোনো সন্তান না থাকায় সর্বশেষ দত্তক বংশধর ছিলেন স্বদেশ রঞ্জন রায় চৌধুরী।

উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি ছিলেন, রাজার রাজপ্রাসাদ ও কোটামন দীঘির মালিক। তিনি ১৯৮২ সালে স্থানীয় শিল্পপতি আশরাফ উদ্দিন আহমেদের (মেনু মিয়া) কাছে বিক্রি করে ভারত চলে যান বলে লোকমুখে এলাকায় প্রচলিত রয়েছে। সেই থেকে আশরাফ আহমেদের পরিবার বিশাল জায়গাটি ভোগদখল করে আসছেন। বর্তমানে জনসাধারণের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

রাজপ্রাসাদ ও বাড়িটি ৮ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজপ্রাসাদের সামনেই অবস্থিত কোটামন দীঘি। রাজবাড়ির পেছনের পুকুর পাড়েই ছিল রাজপ্রাসাদের প্রাচীন অট্টালিকা যা আজ নেই। পরবর্তী সময়ে যা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। রাজার বংশধরদের নির্মাণাধীন কারুকার্যমণ্ডিত বৈঠকখানাও রাখা হয়নি।

কোটামন দিঘির চার পাশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, বাহারি হাজারো ফল গাছ, ফুলের বাগান, আম ও লেবু বাগান রয়েছে। রাজবাড়ি ও কোটামন দীঘির মাঝখানে রয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত বাগান। সেখানে বিভিন্ন জীবজন্তুর ভাস্কর নির্মাণ করা হয়। অনেক বিদেশি অতিথিও কোটামন দীঘি পরিদর্শন করেছেন। ঐতিহাসিক কোটামন দিঘীতে পর্যটকদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করার দাবি স্থানীয়দের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর