কোনো এককালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের মিশ্র চিরসবুজ বনে অবাধে ঘুরে বেড়াত প্রাণীগুলো। দল বেঁধে ওরা শিকার করত হরিণ, বুনো শুয়োর, বন ছাগল, এমনকি গরু-মহিষও। ওদের কবল থেকে বাঘ-চিতাবাঘও রক্ষা পেত না বলে প্রচলিত আছে। অন্তত ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলছিল।
কিন্তু এরপরই ওদের উপর নেমে আসে বিপর্যয়। কৃষি জমি ও মানুষের বাসস্থানের জন্য বন কেটে জমি উদ্ধার, কাঠের জন্য বন উজাড় এবং প্রাণীগুলো ও ওদের খাদ্য অর্থাৎ তৃণভোজী প্রাণীদের অবাধ শিকারের কারণে দিনে দিনে সংখ্যা কমে এক সময়ের সচরাচর দৃশ্যমান (Common) প্রাণীগুলো বর্তমানে একেবারেই বিরল (Rare) ও বিপন্ন (Endangered) হয়ে পড়েছে।
যদিও ২০০০ সাল পর্যন্ত ওদেরকে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যেও দেখা যেত বলে শুনেছি, কিন্তু বর্তমানে ওদের আবাসস্থল মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য জেলাগুলোর অল্পকিছু এলাকা; রাঙামাটির কাসালং ও রাইখং সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, বান্দরবানের সাঙ্গু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ইত্যাদিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তবে, কয়েক বছর আগে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে ওদের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। সেকারণে আমার ধারণা ওরা এখনও রোম-কালেঙ্গা এবং সিলেটের আরও কিছু বনেও থাকতে পারে।
আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে পাল্প উড বিভাগ, কাপ্তাইয়ে চাকুরিরত খালাত ভাই ফরেস্টার শফিকুর রহমানের ওখানে কাছে বেড়াতে গিয়ে ওর কাছেই ওদের সম্পর্কে প্রথম শুনেছিলাম। এরপর ১৯৯৮ সালে কানাডার গুয়েল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এস্টেট অ্যানিম্যাল হসপিটালে পোষা প্রাণীর চিকিৎসায় উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় মেট্টো টরন্টো চিড়িয়াখানায় গিয়ে প্রথম ওদের দেখি। ওখানে কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে ওদের রাখা হয়েছিল।
প্রাণীগুলোর চেহারা, আচরণ ও চলাফেরা শফিক ভাইয়ের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। টরন্টো চিড়িয়াখানায় ওদের দেখে আমি এতটাই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, মনে হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্যেই যেন ওদের দেখছি। কতক্ষণ যে সেই কৃত্রিম বনে হারিয়ে গিয়েছিলাম জানি না, কানাডা প্রবাসী সুমন সাইয়েদ ভাইয়ের ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে এলাম। এরপর পটাপট কয়েকটা ছবি তুললাম। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে মালয়েশিয়ার প্রথম চিড়িয়াখানা তাইপেং জু ও নাইট সাফারিতে দিনে-রাতে ওদেরকে আবারও দেখি।
কয়েক বছর আগে সিলেটের টিলাগড় ইকো পার্কে গিয়ে শফিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, এখনও ওরা টিকে আছে। তিনি ওদেরকে স্বচক্ষে দেখা ছাড়াও বেশ ক’টি অঞ্চলে ওদের পদচিহ্নও দেখেছেন। বন্যপ্রাণী গবেষক ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’-এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহরিয়ার সিজার রহমানের সাথে আলাপকালে জানা যায়, বেশ ক’বছর আগে তারা বান্দনবানের সাঙ্গু-মাতামুহুরী উপত্যকায় ওদের অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন। সাঙ্গু-মাতামুহুরী উপত্যকার স্থানীয় ম্রোদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং সেখানকার বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাস সংরক্ষণে কাজ করতে গিয়ে ম্রোদের ভাষায় ‘শুই’ নামে পরিচিত প্রাণীগুলোর সঙ্গে অন্তত দু’বার তার দেখা হয়েছে। উপত্যকার গহীনে ওদের পায়ের চিহ্নও দেখছেন তিনি। সর্বোপরি ‘ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স’-এর কর্মীদের পাতা ক্যামেরা ফাঁদে বেশ ক’বার প্রাণীগুলোর চলাফেরার চিত্রও ধরা পড়েছে।
হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের পাখি-প্রাণী পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ২০১৯ সালে ওখানকার গাইডদের কাছে আজব এক প্রাণীর কথা শুনি। প্রাণীগুলোকে ওরা চোখে না দেখলেও সেগুলোর দ্বারা গত্যাকৃত গরু ও শুকরের দেহাবশেষ তারা দেখেছেন এবং আমাকেও দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে একটি গবেষক দলের পাতা ক্যামেরা ফাঁদে প্রাণীগুলোর চলাফেরার চিত্রও ধরা পড়ে এবং প্রাণীগুলোর পরিচয় জানা যায়।
যাহোক, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের এই বিরল ও বিপন্ন শিকারি প্রাণীগুলোর নাম রাম কুত্তা। লাল কুত্তা, বন কুত্তা বা ডোল নামেও পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ওরা জংলি কুকুর, চ্যু, সোনহা, সোন বা ডোল নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম এশিয়াটিক ওয়াইল্ড ডগ, রেড ডগ বা ডোল (Asiatic Wild Dog, Red Dog or Dhole)| ক্যানিডি (Canidae) গোত্রভুক্ত প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম Cuon alpinus (কুয়ন অ্যালপিনাস) অর্থাৎ পাহাড়ি কুকুর। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান, নেপাল, চীন ও রাশিয়াসহ এশিয়ার অনেক দেশেই ওদের দেখা মেলে। আগেই বলেছি, একসময় এদেশে ওদেরকে সচরাচর দেখা গেলেও বর্তমানে একেবারেই বিরল ও বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
রাম কুত্তা শিয়াল, কুকুর ও নেকড়ের জাতভাই। তবে চেহারায় শিয়ালের সঙ্গেই মিল বেশি। আকারে নেকড়ে ও শিয়ালের মাঝামাঝি। নাগের আগা থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত লম্বায় ৪৫ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার; লেজ ২০ থেকে ২৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১০ থোকে ২০ কেজি। পা খাটো, লেজ ঝোঁপালো ও নাকের উপরের অংশ খানিকটা উঁচু। মাথা ও দেহের উপরের অংশের লোম বাদামি-লাল। ঋতুভেদে রঙ হালকা থেকে গাঢ় হতে পারে। কানের ভেতরটা, মুখের নিচ, গলা ও দেহের নিচের অংশ সাদা। ঝোঁপালো লেজের আগা কালো।
রাম কুত্তা সামাজিক প্রাণী। দলবদ্ধভাবে থাকে; দিনের বেলা শিকার করে। দলে ২ থেকে ৩০টি পর্যন্ত কুকুর থাকতে পারে। ওরা সচরাচর মাঝারি আকারের প্রাণী, যেমন- হরিণ, শূকর, ছাগল ইত্যাদিকে আক্রমণ করে। প্রয়োজনে বনগরু বা মহিষের মতো বড় পশুকেও আক্রমণ করতে পারে। বন কুকুরের দল কোনো প্রাণীকে সামনে ও পিছনে উভয় দিক থেকেই আক্রমণ করে ও তাড়িয়ে নিয়ে যায়। তাড়াতে তাড়াতে ক্লান্ত করে ফেলে। ওরা যে প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু হিসাব ঠিক করে তাকে না মারা পর্যন্ত ছাড়ে না। তাড়ানো অবস্থাতেই জীবিত প্রাণীটিকে খাবলে খেতে থাকে। আর এভাবে ১০ থেকে ১৫টি কুকুর মিলে অল্প সময়ের মধ্যেই যে কোন প্রাণীকে সাবাড় করে ফেলতে পারে। খাদ্য স্বল্পতার সময় ফল ও সরীসৃপও খায়। কুকুরের মতো ঘেঁউ ঘেঁউ করে না। বরং শিস দেয়ার মতো শব্দ করে ডাকে।
ওরা সচরাচর ভালুক, চিতাবাঘ বা বাঘকে এড়িয়ে চলে; তবে আক্রান্ত হলে তাদেরও রেহাই নেই। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ভারতের জীবজন্তু নামক পুস্তকে লেখক শ্রীরাম শর্মা রাম কুত্তা কীভাবে বাঘকে আক্রমণ সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করেছেন যা সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরছি।
আগেই বলেছি ওরা বাঘকে বেশ সমীহ করে, আর বাঘও ওদেরকে এড়িয়েই চলে। কিন্তু ঘটনাচক্রে যদি ওরা কখনো বাঘের মারা শিকারের কাছে পৌঁছে যায়, আর বাঘ থাবা মেরে যদি দু’একটা কুকুরকে মেরে ফেলে তখন কিন্তু বাঘ মামার আর রক্ষা নেই। তবে তখনই ওরা বাঘকে আক্রমণ করে না। কারণ ওরা জানে বাঘের একেকটা থাবায় একেকটা কুকুরের তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে, এমন কি মারাও যেতে পারে। কাজেই ওরা বাঘকে আক্রমণ না করে খানিকটা দূর থেকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে এবং বিরক্ত করতে থাকে; শান্তিতে থাকতে দেয় না। বাঘ যখন তার শিকার বা মড়ি খেতে বসে তখন বাঘের পিছন দিকে ওরা কামড়ে দেয়। বাঘ যখন রেগে গিয়ে ওখান থেকে উঠে হাঁটা শুরু করে, তখন ওরাও নিরাপদ দূরত্বে থেকে চারদিক দিয়ে ঘিরে বাঘকে অনুসরণ করতে থাকে। বাঘ যখন ক্ষেপে গিয়ে জোড়ে হাঁটতে থাকে তখন রাম কুত্তারাও বাঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোড়ে হাঁটা শুরু করে। বাঘ যখন পিপাসা মেটাতে পানিতে নামে, তখন ওরা বাঘের লেজ ও পিছন দিকে কামড়ে দেয়। বাঘ রেগে গিয়ে পিছন দিকে লাফ দিলে ওরা নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। আবার যখন বাঘ পানি পান করতে যায়, তখন ওরা আবারও বাঘকে জ্বালাতে শুরু করে। কোনোভাবেই বাঘকে পানি পান করতে দেয় না। তবে বাঘকে পানি পান না করতে দিলেও নিজেরা পালাক্রমে পানি পান করে আসে।
যাক, এবার কিন্তু বাঘ ভয় পেয়ে যায় এবং পানি ছেড়ে দূরে গিয়ে একটু আরাম করার জন্য বসে পড়ে। তবে কুকুরগুলো কোনোভাবেই বাঘকে আরামে থাকতে দেয় না। আরাম করতে করতে বাঘ যখন খানিকটা ঝিমুতে শুরু করে, তখন কুকুরগুলো বাঘের মুখে থাবা দেয়। কয়েকটিতে মিলে বাঘের লেজ টানাটানি করতে থাকে। এতে বাঘ খুব অপমান বোধ করে। আর তাই রাগে-দুঃখে বাঘ দৌড়–তে শুরু করে। দৌড়–তে দৌড়–তে বাঘের পায়ের নিচের চর্বি গলে যায় ও বাঘ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ও ক্লান্তিতে বাঘ যখন প্রায় আধমরা হয়ে যায়, তখনই যমদূতের মতো কুকুরগুলো বাঘের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও দেহের বিভিন্ন স্থানে কামড়াতে থাকে। ধস্তাধস্তিতে দু’একটা কুকুর মারা গেলেও নাছোড়বান্দা কুকুরগুলো রনে ভঙ্গ দেয় না। বরং ওরা আরও উদ্যমে বাঘের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও শেষ পর্যন্ত বাঘকে হত্যা করে ছাড়ে।
যাক, এবার রাম কুত্তার প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি সম্পর্কে জানা যাক। ওরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বা পাহাড়ের গুহায় বাস করে। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ওদের প্রজননকাল। স্ত্রী ৬০ থেকে ৬৫ দিন গর্ভধারণের পর মাটির গর্ত বা পাহাড়ের গুহায় ৪ থেকে ৬টি বাচ্চা প্রসব করে। শুধু মা-বাবাই যে বাচ্চা লালনপালন করে তা নয়, বরং একাজে দলের অন্যান্য সদস্যরাও সাহায্য করে। প্রায় এক বছর বয়সে বাচ্চারা পূর্ণবয়স্ক হয়ে যায়। ওদের আয়ুষ্কাল প্রায় দশ বছর।
প্রবন্ধটির লেখক ও আলোকচিত্রী ড. আ ন ম আমিনুর রহমান একজন বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী, প্রাণী চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
E-mail:aminoor69@bsmrau.edu.bd, aminoor69@yahoo.com