ফুরিয়েছে শীতকাল। ফাগুন হাওয়ায় দুলছে গাছের ডালপালা। পথে পথে ঝরা পাতার অপরূপ বিছানা। কান পাতলেই শোনা যায় ঝিরঝিরে বাতাসে ঝরা পাতার কাব্য। আবির রঙে মেতেছে পলাশ ফুল। দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির গাছের সারি।
প্রশান্তির এই দৃশ্যটি রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা বোটানিক্যাল গার্ডেনের। কংক্রিটের চার দেয়াল থেকে বের হয়ে প্রকৃতির সাথে মিলতে কেউ প্রিয়জনের হাত ধরে, দল বেধে বা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উদ্যানে বেড়াতে আসেন। প্রকৃতিপ্রেমী থেকে যুগলবন্দি বা কর্মব্যস্ত নাগরিকসহ সবার যেন- নির্মল বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার স্থান এই বোটানিক্যাল গার্ডেন।
ঋতুরাজ বসন্তে জাতীয় এ উদ্ভিদ উদ্যানের প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে। উদ্যানে ঢুকেই সবার আগে চোখে পড়ে গোলাপ ফুলের বাগান। যেন তারার মত ফুটে আছে হাজারো সাদা, লাল, গোলাপি রঙের গোলাপ। সুবাসে মুগ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টি নিয়ে দেখছেন ফুল প্রেমীরা।
ছুটির দিনগুলোতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে আসছেন দর্শনার্থীরা। সারা বছর তাদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। জাতীয় এ উদ্ভিদ উদ্যানটি বোটানিক্যাল গার্ডেন নামে বেশি পরিচিত।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রকৃতি প্রেমী ও দর্শনাথীদের জন্য রয়েছে নানা আয়োজন। ফুল গাছ, ফল গাছ, ওষুধি, দুইটি গোলাপ বাগানসহ রয়েছে ১১টি লেক-জলাশয়। আরো আছে বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির গাছ। যেগুলো উদ্যানে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
ছোট্ট শিশু লামিহা বাবা মায়ের হাত ধরে এসেছে উদ্যানে ঘুরতে। বদ্ধ কামরা থেকে খোলা জায়গায় এসে খুশিতে আত্মহারা সে। দুরন্ত গতিতে ছুটছে প্রজাপতি আর গঙ্গা ফড়িং ধরতে। তার বাবা জানান," পরিবার সহ এসেছি প্রকৃতির সাথে সুন্দর কিছু সময় কাটাবো। গাছপালা নিরিবিলি পরিবেশ বেশ উপভোগ করছি। বাচ্চারা ও খুশি"।
মিরপুর ২ চিড়িয়াখানার অপর পাশে ২১৫.২২ একর জায়গা জুড়ে এ উদ্যান অবস্থিত। প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। প্রকৃতি প্রেমী, উদ্ভিদবিদ,ও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য উৎকৃষ্ট এ পর্যটন কেন্দ্রে রয়েছে প্রায় ৬৮ হাজার উদ্ভিদ। বৃক্ষ রয়েছে ৩০৬ প্রজাতির, গুল্ম ২০১ প্রজাতির, বিরুৎ রয়েছে ৪৪১ প্রজাতির, লতা ৬২ ও অর্কিড রয়েছে ২১ প্রজাতির। ক্যাকটাস বাগানে ৪২ প্রজাতির ক্যাকটাস রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্রজাপতির প্রজনন কেন্দ্ররূপে পরিচিত গোলাকৃতির পদ্মপুকুর। রয়েছে কৃত্রিম জলপ্রপাত এছাড়া রয়েছে দেশি-বিদেশি নয়নাভিরাম নানা ধরনের গাছ যা মুগ্ধ করছে দর্শনার্থীদের।
শিশুদের খেলার জন্য প্লে জোন,অর্কিট হাউসসহ মোট ৫৭টি সেকশন । দর্শনার্থীদের বসার জন্য ও বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রয়েছে সুব্যবস্থা। পরিশ্রান্ত দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে ক্যামেলিয়া ও পদ্ম নীড় নামে ২ টি বিশ্রামাগার।
এছাড়া দর্শনার্থীদের নামাজের জন্য আছে ১টি মসজিদ, ২টি ওয়াচ টাওয়ার, ৮টি গণশৌচাগার, ৩টি স্ন্যাক্স কর্নার, এবং ১টি গ্রন্থাগার।
জাতীয় এ উদ্ভিদ হারবেরিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় নানা প্রজাতির উদ্ভিদ। ২টি মৌসুমী ফুলের বাগান তার অপরূপ সৌন্দর্য্যের বহিঃপ্রকাশ করছে দর্শনার্থী কাছে।
আগে অনেক অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা নিয়ে অসন্তোষ থাকলে ও বর্তমানে কর্তৃপক্ষ সচেতন। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে উদ্যান টি।
উদ্যানে কর্মরত এক সদস্য জানান, ছুটির দিন ও উৎসবের দিনগুলোতে অনেক লোক সমাগম হয়। ছবি তুলতে প্রকৃতি উপভোগ করতে আসেন সবাই। আমরা চেষ্টা করছি আরও সুন্দর পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা যায়।
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিবেশ এখন খুবই ভালো। আমরা শতভাগ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি।
উদ্যান সম্প্রসারণ ও উদ্ভিদ সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, সামনে আমাদের নতুন প্রজেক্ট আসছে তাতে আমরা বিদেশি ও রেয়ার গাছের সংখ্যা বাড়াবো। এবং প্রজেক্টে বিলুপ্তপ্রায় এমন উদ্ভিদ এর প্রতি বেশি নজর দেবো। সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সব সময় লোক নিয়োগ আছে।
সুন্দর এই প্রকৃতির মাঝে বর বধূ বেশে ব্রাইডাল ফটোশুট করতে আসছেন অনেকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে সুন্দর ছবি তুলে তারা তাদের বিশেষ এদিনটি স্মরণীয় রাখতে চান। আবার দলবেঁধে আসা বন্ধুরা একসাথে মিলে গিটার খঞ্জনি নিয়ে গলা ছেড়ে গান করছে। কেউ মেতেছে আড্ডায়।
উদ্যানের বন্য প্রকৃতিতে দেশীয়, পরিযায়ী পাখির কল্লোলে মুখরিত চারদিক। কাঠবিড়ালি অবাধে বিচরণ করছে গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে। ঝোপের আড়ালে শিয়াল আর বেজির উপস্থিতি ও টের পাওয়া যায় মাঝে মাঝে।
সারাদিন নানা বয়সী দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর থাকে বোটানিক্যাল গার্ডেন। প্রতি বছর ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বনভোজনে, উদ্ভিদ সংক্রান্ত জ্ঞান অন্বেষণে, সবুজ প্রকৃতি উপভোগ করতে প্রায় ১৫ লাখ দর্শনার্থী উদ্যানটিতে আসেন। নৈসর্গিক মায়ায় মুগ্ধ হতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন তারা।