কণ্ঠের সুর তেমন ভালো নয়। সুরে নেই শিল্পীর মতো মাধুর্য। তবুও তিনি হাতে ডুগডুগি আর বেহালা নিয়ে জীবিকার তাগিদে পথে পথে গান করে বেড়ান। শিল্পী হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলেও সাধারণ মানুষ তাকে বাউল হিসেবেই চিনেন। তার গান শুনে মানুষ যে টাকা দেয় তাতেই চলে পথের বাউল রোকন উদ্দিনের চার সদস্যের সংসার। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন তিনি।
রোববার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে নেত্রকোনার কেন্দুয়া পৌর শহরের সাজিউড়া মোড় সংলগ্ন আব্দুস সালামের চায়ের দোকানে দেখা মিলে এ বাউলের। ওই চা দোকানেও তিনি উপস্থিত কয়েকজন গ্রামপুলিশ সদস্যকে গান শোনাচ্ছিলেন। এ সময় উপস্থিত শ্রোতারাও মনোযোগ দিয়ে বাউলের গান শুনছিলেন।
গান শেষে কথা হয় বাউল রোকন উদ্দিনের সাথে। তিনি জানান, তার বাড়ি কিশোরগঞ্জ উপজেলার রাউতি গ্রামে। ওই গ্রামের সুলতান উদ্দিনের ছেলে তিনি। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান রোকন উদ্দিন ছোটবেলা থেকেই খুব দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেন। শিশুকালে এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়ার পর তার দুচোখের জ্যোতি কিছুটা কমে যায়। তাছাড়া দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় লেখাপড়া করারও সুযোগ হয়ে উঠেনি তার।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল তার। তাই এলাকার প্রতিষ্ঠিত বাউল সাধক মকবুল হোসেনের প্রথম শিষ্য আব্দুল মান্নানের কাছে গান শেখার হাতেখড়ি নেন। কিন্তু গান করাটা তার তেমনভাবে হয়ে উঠেনি। শারীরিক অক্ষমতার জন্য দিনমজুরি কিংবা অন্য কোনো ধরনের কাজেও যেতে পারেননি। খুবই মানবেতর দিনযাপন চলছিল তার। এরইমাঝেই সংসার পাতেন।
সংসারী হওয়ার পর রোকন উদ্দিন উপলব্ধি করেন জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি। যেহেতু তিনি কোনো ভারী কাজকর্ম করতে পারেন না, তাই কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করবেন- ভেবে পাচ্ছিলেন না। রোকন দেখলেন একমাত্র ভিক্ষা করা ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। কিন্তু মানুষের কাছে হাত বাড়াতে তিনি নারাজ। অবশেষে ডুগডুগি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথে পথে ও এলাকার বিভিন্ন বাজারে, চায়ের দোকানে দোকানে মানুষ গান শোনাতে লাগলেন। আর এতে খুশি হয়ে মানুষ তাকে যে টাকা দেয় সেই টাকা দিয়েই চলে তার সংসার চলতে থাকে। ধীরে ধীরে গানের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহের পথ পেয়ে যান তিনি।
বাউল রোকন উদ্দিন বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ জেলার নিজ উপজেলা তাড়াইলের বিভিন্ন বাজারসহ পাশ্ববর্তী নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা ও ময়মনসিংহের নান্দাইল এবং ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাজারের পথে পথে, চায়ের দোকানে নিয়মিত গান করে থাকেন বলে জানান। তবে বর্তমানে তিনি নিজ এলাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বাইরেও মানুষকে গান শোনাতে যান। আর সারাদিন গান শুনিয়ে ভালোই উপার্জন হয় তার। যা দিয়ে অনায়াসেই চলে সংসার।
বর্তমানে এক মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের পিতা বাউল রোকন আরো জানান, তার এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। মেয়েটা এ বছর অষ্টম শ্রেণিতে ও ছেলেটা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেশ সুখেই কাটছে তার সংসার।
রোকন উদ্দিন বলেন, আমার ভালো লাগে যে, আমি ভিক্ষা করি না। আমি পথে পথে, বিভিন্ন বাজারে ও চায়ের দোকানে মানুষকে গান শোনাই। আর গান শুনে মানুষ আমাকে যে টাকা দেয় তাতেই আমার সংসার চলে। এভাবেই পনেরো বছর ধরে সংসার চালিয়ে আসছি।