যানবাহনের যানজট আর মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত মৌচাক মোড়ের ঠিক মধ্যভাগে চোখে পড়বে সাদা টাইলসের মোড়ানো একটি স্তম্ভ। এই মোড় দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। কিন্তু ৯০ ভাগ মানুষই জানেন না এই স্তম্ভটি আসলে কিসের এবং কেন! স্তম্ভটি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ফারুক ইকবাল এবং শেষ শহীদ তসলিম উদ্দিনের সমাধিস্থল।
দুই শহীদের সমাধিস্থলের তিন পাশ দিয়ে চলাচল করা সাধারণ মানুষেরও বা কি দোষ। খুব কাছে গিয়ে না দেখলে সাধারণ চোখে স্থানটি দেখে বুঝারও উপায় নেই এখানেই শুয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এবং শেষ শহীদ। সমাধিসৌধের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ময়লা আবর্জনা আর মোটরসাইকেল পার্কিং দেখে মনে হবে যেন এটি একটি অবহেলিত সাধারণ নির্মাণ।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ, পাকিস্তানের পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ছাত্র-জনতার মিছিল নিয়ে ঢাকার রামপুরায় অবস্থান করছিলেন আবুজর গিফারী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছাত্রলীগ নেতা ফারুক ইকবাল। উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সেখানেই তাকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। শহীদ হন ফারুক ইকবাল। সেসময় মৌচাক মোড়ে সমাহিত করা হয় তাকে।
ফারুক ইকবালের পাশেই সমাহিত করা হয় মুক্তিযুদ্ধের শেষ শহীদ কিশোর তসলিম উদ্দিনকে। সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ১৭ই ডিসেম্বর ঘাতকদের হাতে নিহত হন।
মুক্তিযুদ্ধের ৩৭ বছর পর ২০০৮ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন শহিদদের সমাধিস্থলে নির্মাণ করেন সমাধিসৌধ। তবে সমাধিসৌধটি দেখভালের দায়িত্ব কাউকে না দেওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সেটি পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়।
এই দুই বীর শহিদের স্মৃতি এবং তাদের সমাধিসৌধের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় শহীদ ফারুক ইকবালের বড় ভাই এএনএম জুলফিকার হারুন ও শহীদ তসলিম উদ্দিনের ভাই জাহাঙ্গীর হাসান মানিকের সাথে।
শহীদ ফারুকের বড় ভাই জুলফিকার হারুন বার্তা২৪-এর সাথে আলাপকালে ভাইয়ের সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ফারুক যেদিন শহীদ হয় পল্টন ময়দানে সেদিন ছাত্রলীগের মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধুর আসার কথা ছিল। সেই মিটিং অরগানাইজ করার জন্যই সে নাস্তা না করেই সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আবুজর গিফারী কলেজের সামনে থেকে ফারুক যখন মিছিল নিয়ে রামপুরার দিকে রওনা হয় তখন আমি সেখানেই ছিলাম। আমি বাসায় চলে আসলাম। একটু পর একজন এসে বলল রামপুরায় একজনকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করেছে। এই কথা আম্মা শুনে বলে উঠল ‘আল্লাহ জানেন কোন মায়ের বুক জানি খালি হল’। আমি বাসা থেকে বের হয়েই দেখি একটা ছেলে ফারুকের পায়ের জুতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখেই বুঝে ফেললাম ঘটনা কি! এটাই ছিল ফারুককে আমার শেষ দেখা। এভাবেই ভাই ফারুকের শহীদ হওয়ার ঘটনা বলছিলেন হারুন। এবং জানান সেদিন ফারুকের জানাজায় ছাত্রনেতা বীরবিক্রম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ অনেক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম না থাকা নিয়ে জুলফিকার হারুন বলেন, পরিবার থেকে আমরা কখনও আবেদন করিনি তালিকায় নাম তোলার জন্য। এরশাদ সরকারের আমলে একবার একটা ফরম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আব্বা আবেদন করতে দেননি। আব্বার একটাই কথা ‘আমার ছেলে শহীদ হইছে, এটাই সম্মানের। এর বিনিময়ে সরকার থেকে আমরা কোনো সুবিধা নেব না। এরপর আর আবেদন করা হয়নি। সরকার থেকেও আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। শুধুমাত্র ৩ মার্চ এলেই সমাধিসৌধে ফুল দিয়ে, একটু আলোচনা সভা করে সবাই আবার ভুলে যায়। তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদকে তুলে ধরার জন্য সরকার যদি কোনও ব্যবস্থা নিতো তাহলে সবাই তার ব্যপারে জানতে পারতো।
৩ মার্চ যখন শহীদ ফারুক ইকবালের মরদেহ বাড়িতে আনা হয় তখন কফিনের সামনে পেছনে হাজার হাজার মুক্তিকামি মানুষের মিছিল। কে জানতো বাড়ির উঠানে তখন অবস্থান করছিল দেশ প্রেমিক আরেক শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ তসলিম উদ্দিন- ঠিক এভাবেই নিজের ভাইয়ের গল্পটা শুরু করলেন জাহাঙ্গীর হাসান মানিক।
শহীদ তসলিম উদ্দিনের ভাই জাহাঙ্গীর হাসান মানিক বলেন, হাজার হাজার জনতা যখন স্লোগান দিতে দিতে ফারুক ভাইয়ের (শহীদ ফারুক ইকবাল) মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসলো এই দৃশ্য দেখেই আমার ১৩ বছরের ভাই মাকে বলে ‘দেখ মা, ফারুক ভাই কত ভাগ্যবান! হাজার হাজার জনতা তাঁর মরদেহ নিয়ে মিছিল করছে! তাঁর মৃত্যু নতুন ইতিহাসের সূচনা করছে!’ মা ধমক দেয়, "চুপ কর! কী সব অলুক্ষণে কথা কস!" মায়ের ধমকে ভাই তখন চুপসে যায়।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে শুরু হয় পাকবাহিনীর বর্বরতা, শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। সে রাতে ঢাকার যে আগুন তসলিম দেখেছে, সেই আগুনই তসলিমের মধ্যে জন্ম নেয় আগ্নেয়গি। মা-বাবা লক্ষ করলো কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেল সে। আগের মত তার মধ্যে চঞ্চলতা নেই, আবার কারো সঙ্গে ঠিক মত কথাও বলেনা। জানতে চাইলেও ভাই মা-বাবাকে কিছু বলেনি। এভাবে চলতে থাকার মধ্যে মার্চ কিংবা এপ্রিলে হঠাৎ একদিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তসলিমকে। বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এর কয়েকদিন পরই জানা যায়, তৎকালীন আমাদের এলাকারই আলাউদ্দিন সুইট- এর ম্যানেজার আজিম খোকন, বাচ্চ্ ও তসলিমকে যুদ্ধে পাঠাতে সহযোগিতা করে।
১৩ বছরের তসলিম যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করছে। সে বাসায় না থাকায় এদিকে শহরের রাজাকারদের সন্দেহ তসলিম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। তাই ক'দিন পরপরই বাসায় পাকিস্তানি আর্মি নিয়ে এসে আব্বাকে খুব বিরক্ত করতো। ৮ বার আব্বাকে আর্মিরা তুলেও নিয়ে গেছিল। তসলিমের কোনও খোঁজ না পাওয়ায় আমাদের বাসা জ্বালিয়েও দিয়েছিল। আমাদের অন্যত্র গিয়ে থাকতে হয়েছে এই পাকিস্তানিদের অত্যাচারে।
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়। তসলিমরা জয়ী হয়। একটি নতুন সকাল ১৬ ডিসেম্বর। দেশ আজ স্বাধীন। জনতার বিজয়ের উল্লাসের সাথে পৃথিবীর সব খুশি যেন বাবার মধ্যে। বাবার অপেক্ষা শেষ হয় ১৭ ডিসেম্বর। মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করতে এলাকার মানুষ বিজয় স্লোগান দিচ্ছে। একে একে তসলিমদের দলের প্রধান মোশাররফসহ আরও অনেকেই ফিরে এসেছে। কিন্তু তসলিম আর ফিরল না।
যে ফারুক ভাইয়ের মরদেহ দেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তসলিম, মৌচাক মোড়ে সে ফারুক ভাইয়ের কবরের পাশেই তাকে কবর দেওয়া হয়- বলেই চোখের পানি মুছলেন শহীদ তসলিম উদ্দিনের ভাই জাহাঙ্গীর হাসান মানিক।
এভাবেই ঢাকার মৌচাক মোড়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম এবং শেষ শহিদের সমাধিস্থল পাশাপাশি।
তবে ফারুক-তসলিমের সমাধিসৌধের বর্তমান অবস্থা দেখে কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই দুই শহীদের দুই ভাই জানান, যদি সরকার থেকে সমাধিসৌধের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ না করা হয় তাহলে দুই পরিবার থেকেই যতটুকু সম্ভব করা হবে। অন্তত সমাধিসৌধের স্থানটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেখানে বড় করে দুই শহীদের নামফলক লাগাবেন। যাতে মানুষ দূর থেকেই দেখতে পারে এবং ফারুক-তসলিম সম্পর্কে জানতে পারে।