ষাটোর্ধ্ব সখিনা খাতুন। শরীরজুড়ে ক্লান্তি ও বার্ধক্যের ছাপ। একটু হাঁটলেই হাঁসফাঁস লাগে; শক্তি পান না। তবুও পেটের তাগিদে প্রতিদিন মানুষের বাড়ি বাড়ি যান গৃহস্থলীর কাজ করতে। মাসে সামান্য কিছু টাকা পান তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া ও তিন বেলা ভরপেট জুটে না সখিনার।
চৈত্রের দুপুরে রাজধানীর মিরপুরের রাস্তায় কাজে যাওয়ার সময় কথা হয় এই বৃদ্ধ গৃহকর্মীর সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে আসে তার অসহায়ত্বের কাহিনী ও জীবন সংগ্রামের গল্প।
সখিনা খাতুন জানালেন, তার শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ। কাজ করার শক্তি না থাকলেও কোন উপায় নেই তার। জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন ছোটেন গৃহপরিচারিকার কাজে। বয়সের কারণে কাজ করতে সময় বেশি লাগে বলে, কাজেও রাখতে চাননা অনেকেই।
সখিনা খাতুন থাকেন মিরপুর এলাকায় পশ্চিম শেওড়াপাড়া ওয়াসা রোডের অপরিচ্ছন্ন এক বস্তিতে। টিন দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা খুপড়ি ঘরে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, "আমার জীবনডাই গেল দুখে দুখে। সেই ছোড কালে বাপ মা হারাইছি। পোলার বাপে পোলা হওনের পরে আমারে থুইয়া আবার বিয়া বসলো। অল্প বয়স থেকেই আমি জীবনের সুখ বলে কি জিনিস তা পাইনি। দ্যাশে কাম কাজ পাই নাই অনেক অসহায় হইয়া চলছি কেউ দেখে নাই আমারে মা । ছোট্ট পোলাডারে বুকে কইরা সেই কবে আইছি ঢাকা শহর। আগে যখন শরীরের জোর ছিল অনেক বাড়িতে কাম করতাম অহন পারিনা। "
সখিনার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দার নাজিরপুর গ্রামে। অল্প বয়সে বাবা মা হারান এই নারী। এরপর স্বামীর সংসারে জীবনের হাল ফেরাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, এক পর্যায়ে স্বামীও সন্তানসহ ফেলে চলে যান। পরে ছেলেকে নিয়ে জীবিকার তাগিদে আসেন। বস্তিতে থেকে মানুষের বাসায় কাজ করা শুরু করেন। প্রথমদিকে ছেলেকে আঁচলের সাথে বেঁধে রেখে কাজ করতেন। ইচ্ছা থাকলেও অর্থাভাবে পড়াশোনা করাতে পারেননি। ছেলে বড় হয়েছে। ভ্যানে করে লেবু, শসা, ধনে পাতা বিক্রি করে। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে নিজের সংসার চলে না তবুও ঘর ভাড়া দিতে প্রতি মাসে মাকে কিছু সাহায্য করেন।
সখিনা খাতুন গৃহকর্মীর কাজে মাসে এক বাসা থেকে ২০০০ টাকা পান। যে বাড়িতে কাজ করেন তাদের বেঁচে যাওয়া বাসি খাবারের তার এক বেলা চলে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এ সময়ে এত স্বল্প আয়ে তিন বেলা খাবার জোটানোই কষ্ট। পুষ্টির যোগান থাকে বহু দূরে । চিকিৎসা খরচেরও একই হাল।
সখিনা খাতুন আফসোস করে বলেন, ‘ঈদ মুখে আমার নাতিডা দাদির কাছে আইছে। ওর কোন নতুন জামা নেই। যে বাড়িতে কাম করি ওইখানে নিয়ে যাইতেছি দেখি কিছু দেয় কিনা।’
বৃদ্ধ সখিনা খাতুন জীর্ণ রুগ্ন দেহ নিয়ে প্রতিদিন বের হন গৃহ পরিচারিকার কাজে। বড়লোক বাড়ির আসবাব, খাদ্যদ্রব্য প্রতিদিন ছুঁয়ে দেখলেও নিজে কত বেলা পার করেন অনাহারে থেকে, রাত কাটান ছোট্ট শক্ত চৌকির উপর। নিজে মলিন বস্ত্র পরে দিন কাটান তবে নিজের জন্য না হলেও ছোট্ট নাতির নতুন ঈদের পোশাকের জন্য মন পোড়ে তার।
এখন আশা, যে বাসায় কাজ করেন তারা যদি সামান্য টাকা বকশিশ দেন; সেই টাকায় নাতির জন্য কিনবেন ঈদের পোশাক।