৬৪ তম জেলা ভ্রমণ: আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ

বিবিধ, ফিচার

ফরিদ ফারাবী | 2023-08-31 10:17:04

ডিসেম্বরের কনকনে শীতে বগুড়া থেকে নওগাঁ হয়ে যখন রাজশাহী পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় নয়টা বেজে গেছে। যদিও এযাত্রায় গন্তব্য পশ্চিমের সর্বশেষ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ তবু মাঝখানে রাজশাহী শহরটাই বা বাদ যাবে কেনো! সাথের ট্যুরমেটের শিক্ষাজীবনের লম্বা সময় কেটেছে এখানে সেই সূত্রে এশহর তার খুব বেশি আপন। আমার ঘুরে দেখার আগ্রহের চাইতে তার ঘুরিয়ে দেখানোর আগ্রহ কোনটাই কম না।

বাস থেকে নেমেই যথারীতি একটা ছোটখাটো চক্কর দিয়ে ফেললাম। এতো পরিচ্ছন্ন এবং বিশুদ্ধ বাতাসের শহর আমি বাংলাদেশে আর পাইনি। এর আগে রাজশাহী এসেছিলাম প্রায় পাঁচ বছর আগে তখন অবশ্য শহরটাকে এভাবে দেখা হয়নি। এই ক'বছরেই বেশ বদলে গেছে শহরের হালচাল। হাঁটছিলাম উদ্দেশ্যহীন শহরের এক প্রান্ত ধরে। হাঁটার সময় খুব একটা টের পাওয়া না গেলেও রিক্সায় উঠে হিমেল বাতাসে ঠান্ডা বেশ টের পাচ্ছিলাম। লক্ষীপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা গল্পে কাপের পর কাপ চা শেষ করে রাত্রিযাপনের জন্য রামেক-এর হলে ফিরলাম বেশ দেরি করেই।

ভেতরে ততক্ষণে এক অদ্ভুত উত্তেজনা কাজ করছে। জেলা গণনার হিসেব নিকেশ যদিও সেভাবে কখনো করিনি তবু সামনে যখন চলেই এলো, একটা মাইলফলক তো বটেই। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে যাচ্ছে আমার সুদীর্ঘ এক্সপ্লোরেশনের ৬৪ তম জেলা। বিজয় দিবসের দিনে এমন মাইলফলকে পৌঁছানোর চাইতে স্মরণীয় আর কী-বা হতে পারে!

ভোরের আলো ফোটার আগেই ফোনের এলার্মের শব্দে ঘুম ভাংলো। ভ্রমণের পুরোটা দিনকে কাজে লাগাতে একটু তাড়াতাড়ি বের হওয়ার কোন বিকল্প নেই। অল্প সময়ের মধ্যেই ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে হাটঁতে হাটঁতেই বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌছলাম। পাশের চায়ের দোকানের ধোঁয়াতোলা কেটলি আর চায়ের কাঁচা পাতির সুবাস পেয়ে আর বসে থাকা গেলোনা। চা শেষ করতেই বাস এসে পৌছালো। প্রায় ঘণ্টাখানেক লাগলো চাঁপাই পৌঁছাতে। বাসস্ট্যান্ডে নেমে হাটঁতে হাটঁতে জেলা পরিষদ হয়ে স্টেডিয়াম পৌঁছলাম। ১৬ই ডিসেম্বর হওয়াতে পুরো এলাকাতে একটা সাজ সাজ রব। স্টেডিয়ামে চলছে কুওচকাওয়াজ। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো ভেতরের এলাকা কানায় পরিপূর্ণ। টের পেলাম বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। খোঁজাখুঁজির পর সামনের রেস্টুরেন্টে গিয়ে ডিম খিচুড়ির নাস্তা সেরে নিলাম। সারাদিন ঘোরার প্রস্তুতিতে সকাল সকাল একটু ভারি নাস্তায় বাকি দিন নির্ভার থাকা যায় লম্বা সময়ের জন্য।

নাস্তা পর্ব সেরে একটা রিক্সা নিয়ে পুরো শহর ঘুরে সরাসরি মহানন্দার পাড়ে পৌঁছলাম। কিছুপথ হেটে ব্রীজ পার হয়ে কানসাট পর্যন্ত অটোরিক্সায় উঠলাম। অটো চলছিলো রাস্তার দুপাশের আমবাগান ছাড়িয়ে। ছোট ছোট এই গাছগুলোই গ্রীষ্মকালে আমের ভারে মাটিতে নুয়ে থাকে। এখানে কেউ কারো আমে হাত দেয়না। এমনকি ট্যুরিস্ট হলেও গাছ থেকে আম ছিড়ে নেয়াটা খুবই গর্হিত কাজ।

কানসাট থেকেই সোনা মসজিদের অটোরিক্সা পেলাম। দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। সোজা রাস্তা চলে গেছে স্থলবন্দর পর্যন্ত। কাছাকাছি আসতেই বাংলাবান্ধা, বেনাপোলের মত স্থলবন্দরের একটা পরিচিত চেহারা ভেসে উঠলো। ছোট সোনা মসজিদের সামনেই নেমে গেলাম। ছুটির দিন হওয়াতে বেশ ভীড় দেখা গেল মসজিদ প্রাঙ্গনে। এতোটা ভীড় আশা করিনি। তবু কী আর করা! মসজিদের পাশেই চোখে পড়লো বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও মেজর নাজমুল দুই মুক্তিযোদ্ধার সমাধি।

ছোট সোনা মসজিদে~

ছোট সোনা মসজিদ দেশের অন্যতম পুরনো স্থাপনা। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে নির্মিত এই মসজিদটিকে বলা হয়ে থাকে সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন। মুলত নুসরত শাহ নির্মিত গৌড়ের সোনা মসজিদের মতই সোনালী গম্বুজ হওয়াতে এই মসজিদটিকে বলা হতো ছোট সোনা মসজিদ। জানা যায় সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহ-এর শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ) জনৈক মনসুর ওয়ালি মোহাম্মদ বিন আলী মসজিদটি নির্মান করেন। সে হিসেবে এই মসজিদের বয়স এখন প্রায় ৫০০ বছরের বেশি।

মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ২৫ মিটার লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১৭ মিটার চওড়া। চারকোনায় রয়েছে চারটি তুঘলক পদ্ধতির বুরুজ। এছাড়া মসজিদের সামনের অংশে দরজার সংখ্যা মোট পাঁচটি। ভেতরের ৮টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের উপর তৈরি হয়েছে ১৫টি গম্বুজ। মাঝের মেহরাব ও পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজার মধ্যবর্তী অংশে ছাদের ওপর যে গম্বুজগুলো রয়েছে সেগুলো চৌচালা গম্বুজ। পুরো মসজিদের অলংকরণে মুলত ব্যাবহৃত হয়েছে পাথর, ইট ও টেরাকোটা। যাতে খোদাই করা আছে নানান নকশা। তবে এই টাইপের নকশা আমি অন্যান্য পুরনো কোন মসজিদের গায়ে দেখিনি। সারা বাংলাদেশে ৬৪ জেলার যত প্রাচীন মসজিদ দেখেছি তার মধ্যে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের পর এই মসজিদটি-ই আমার নজর কেড়েছে।
মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধীতে শ্রদ্ধা জানিয়ে আগেই ঠিক করে রাখা ভ্যানে করে রওয়ানা হলাম তাহখানার উদ্দেশ্যে।

তাহখানা ও তিন গম্বুজ মসজিদে~

ছোট সোনা মসজিদ থেকে ৫০০ মিটার উত্তর পশ্চিমে জাহেদুল বালা দীঘির পশ্চিম পাড়ে তাহখানা অবস্থিত। সুবেদার শাহ সুজার শাসনামলে নির্মিত এ স্থাপত্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। ভাবতেই পারিনি এখানে এমন চমৎকার স্থাপনার দেখা পাবো। আয়তাকার আকৃতির এই দুইতলা বিশিষ্ট ইমারত ঢাকার লালবাগ কেল্লার কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় দুইটি অষ্টকোণাকৃতির কক্ষসহ উপর তলায় মোট সতেরোটি কক্ষ রয়েছে।

তাহখানার নির্মানের কারণ সম্পর্কে দুইটি মতামত পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় সুবেদার শাহ সুজা অবকাশ যাপন এবং তার আত্মাতিক গুরু শাহ নিয়ামত উল্লাহ (র) – এর সাথে স্বাক্ষাতের জন্য এখানে আসতেন। সে জন্যই ১৬৩৯ থেকে ১৬৬০ সালের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে এই ইমারত নির্মান করেন। এছাড়াও মনে করা হয় শাহ নিয়ামত উল্লাহ (রঃ)- এর বসবাসের জন্যও তিনি এই ইমারত নির্মান করে থাকতে পারেন।

তাহখানার মূল প্রাসাদ থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে সামান্য দূরে রয়েছে শাহ্ নিয়ামত উল্লাহ এর সমাধি ও মসজিদ। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের ভেতরে বাহিরে তেমন উল্লেখযোগ্য কারুকাজ না থাকলেও এর স্থাপত্য এক কথায় অসাধারণ। মসজিদের ৩টি প্রবেশ পথ এবং ভেতরে ৩টি মেহরাব রয়েছে। স্থানীয় জনসাধারণ এই মসজিদে নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করে থাকেন। মসজিদের পাশেই শাহ নিয়ামত উল্লাহ –এর সমাধি। বর্গাকার নকশা পরিকল্পনায় নির্মিত সমাধি কমপ্লেক্স ঘিরে ভক্ত দর্শণার্থীদের ভীড় এড়িয়ে বের হয়ে এলাম।

দারসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা~

ভ্যানওয়ালকে জিজ্ঞেস করলাম এর পরে কোথায় যাচ্ছি? গন্থব্য জানালেন দারসবাড়ি মসজিদ এবং মাদ্রাসা এলাকায়। ছোট সোনামসজিদ ও কোতোয়ালী দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরের কাছেই দারসবাড়ি অবস্থিত। মুলত আরবী দারস অর্থাৎ 'পাঠ' শব্দ থেকে দারসবাড়ি শব্দের উৎপত্তি। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছলাম মসজিদের সামনে। ছাদ ধ্বসে পরে অনেকটাই ধ্বংসস্তুপের মত অবস্থা তবে পূর্বেকার স্থাপত্যের জৌলুশ ঠিকই ধরে রেখেছে দেয়ালের টেরাকোটা ও ডিজাইনগুলো। ভেঙ্গে পড়ার আগে কতটা অসাধারণ ছিলো এই স্থাপনা তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে জানা যায় সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহ-এর রাজত্বকালীন সময়ে ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে তারই আদেশে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অক্ষত অবস্থায় কোন অংশেই সোনা মসজিদের চেয়ে কম সুন্দর ছিলোনা এই মসজিদ। ইট নির্মিত এই মসজিদের অভ্যন্তরের আয়তক্ষেত্র দুই অংশে বিভক্ত। উপরে ৯টি গম্বুজের চিহ্নাবশেষ রয়েছে এবং উত্তর দক্ষিণে ৩টি করে জানালা ছিল। উত্তর পশ্চিম কোণে মহিলাদের নামাজের জন্য প্রস্তর স্তম্ভের উপরে একটি ছাদ ছিল। এর পরিচয় স্বরূপ এখনও একটি মেহরাব রয়েছে। এ মসজিদটি বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যের কীর্তির একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এখানে প্রাপ্ত তোগরা অক্ষরে উৎকীর্ণ ইউসুফি শাহী লিপিটি এখন কোলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত আছে।

মসজিদের দেড়শ মিটার দূরেই দারসবাড়ি মাদ্রাসা। মাদ্রসার মূলত এখন কোন অস্তিত্ব নেই। অনেকটা পাহাড়পুরের প্রত্নতাত্বিক নিদর্শণের মত দেখতে এই এলাকায় মাটির নিচে চাপা পড়া শুধু কক্ষগুলোর চিহ্ন রয়েছে। এখানে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে উদঘাটিত তথ্য অনুসারে মাদ্রাসাটি আলাউদ্দীন হুসেন শাহ-এর আমলে ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। ধারণা করা হয়ে থাকে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মাদ্রাসার নিদর্শণ।

চামচিকা মসজিদে~

মাদ্রাসা এলাকা ছাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণকবর পেরিয়ে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের কিছু আগে ডান দিকে চামচিকা মসজিদে চলে এলাম। এখানে আমবাগানের পাশে কয়েকটা পিকনিক গ্রুপের বাস দেখতে পেলাম। পাশেই সাউন্ডবক্স বাজিয়ে হৈ হুল্লোড় চলছে। পাশ কাটিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে পৌছলাম।

খুব একটা বড় না হলেও বেশ ভালো অবস্থায় রয়েছে স্থাপণা। চামচিকা মসজিদের নামকরণের ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় ভারতের বড় চামচিকা মসজিদের আদলেই এটি তৈরী। দারসবাড়ী মসজিদের মতই পোড়ামাটি ইট ও কারুকার্য খচিত এই মসজিদটি। এর দেয়ালের পরিধি এত মোটা যে চৈত্র মাসের প্রচন্ড গরমে এর ভিতরে শীতল পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। মসজিদের পূর্বে ৬০ বিঘা আয়তনের খঞ্জন দিঘী নামে একটি বড় দিঘী রয়েছে। মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে চলে এলাম বর্ডারে অবস্থিত কোতয়ালি দরজার কাছাকাছি। খুব বেশি সময় অবস্থান না করে দূর থেকেই দেখে বিদায় নিয়ে পাশের বাস কাউন্টারে এলাম।

বিদায় চাঁপাই~

বিকেল হয়ে এসেছে সারাদিন ঘুরতে ঘুরতে। এর মধ্যে পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি আমাদের। পরিকল্পনা ছিলো বিকেলে রাজশাহী ফিরে পুঠিয়া রাজবাড়িটাও ঘুরে যাবো। তবে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে টের পেলাম সেটা দুঃসাধ্যই হবে বটে। তবু ফেরার পালা আমাদের। ভাবতেই ভালো লাগছে রাজশাহীতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে কালাই রুটি এবং হাঁসের মাংস। আর হ্যাঁ যারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঘুরতে যাবেন শিবগঞ্জের মিষ্টির কথা একদম ভুলবেন না। একটা কথা নিসন্দেহে বলা যায়, যদি আপনি প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাচীন স্থাপত্যের প্রতি আগ্রহী হোন তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আপনাকে মোটেও হতাশ করবেনা।

 ৬৪ তো শেষ হলো এবার না হয় সীমানা পেরিয়ে ১০০ হোক! অন্তত স্বপ্ন দেখতে তো দোষ নেই।

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর