‘রুধিবি কি দিয়া সাগর জোয়ার আকাশে যখন উঠেছে চাঁদ’

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 16:38:23

জাগ্রত বাংলাদেশের গগনস্পর্শী অভিব্যক্তি মূর্ত হয়েছিল ঊনসত্তর, সত্তর, একাত্তরে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্নিগিরিসম লেলিহান শিখা ব্যক্তিতে, সমাজে, জনপদে, রণাঙ্গনে জ্বলে উঠেছিল সর্বব্যাপী প্লাবনে। নজরুলের দ্রষ্টার চোখ যেন দেখেছিল সেই জনবিস্ফোরণ: ‘এই যৌবন জলতরঙ্গ রুধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ/রুধিবি কি দিয়া সাগর জোয়ার আকাশে যখন উঠেছে চাঁদ।’

স্বাধীনতার চন্দ্রালোকিত আকাশের তলে জাগ্রত বাংলাদেশ ও বাঙালিকে কোনোভাবেই থামানো যায় নি। ব্যক্তি থেকে জাতিসত্ত্বার জেগে উঠার অমোঘ পরিণতিতে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে মানুষ ইতিহাসের নায়ক হয়ে বিনির্মাণ করেছিল ঐতিহাসিক বাংলাদেশ, তাদের সবার কথা আজো জানা হয় নি। মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা ছেনে বের করছেন অসম সাহসী মানুষের স্বাধীনতার স্পৃহা ও লড়াইয়ের কাহিনি।

চট্টগ্রামের কবি, নাট্যজন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অভীক ওসমান বাঙালি জাতির উত্থানপর্বের ঐতিহাসিক কালপর্বগুলোর ধারাবাহিকতায় বেড়ে উঠেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের শঙ্খ নদীর তীরবর্তী চন্দনাইশ থেকে কৈশোর-যৌবনে আগমন করেন শহর চট্টগ্রামে। জাতীয় আন্দোলনের অভিঘাতে চট্টগ্রামে-সৃষ্ট স্ফুলিঙ্গের স্পর্শে তিনি নিজেকে জারিত করেন। বাঙালির গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ তার জীবনের সমান্তরালে প্রবহমান।

পথনাটক, কবিতা, গবেষণা, স্মৃতিকথার পাশাপাশি অভীক ওসমান চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়গুলোকে পুনঃনির্মাণ করছেন। রচনা করেছেন ‘শহিদ মেজর নাজমুল হক: সেক্টর ৭-এর বিস্মৃত কমান্ডারের উপাখ্যান’। দক্ষিণ চট্টগ্রামের এই বীর ও শহিদ কমান্ডারের কীর্তি ও অবদানকে বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে এনেছেন।

বৃহত্তর চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশের সাতকানিয়া/লোহাগাড়ার মেজর নাজমুল হক হতে চেয়েছিলেন প্রকৌশলী। কিন্তু জাতীয় ইতিহাসের পালাবদল তাকে এনে দাঁড় করায় মুক্তির ময়দানে। তিনি ৭ নং সেক্টরের কমান্ডার হয়ে শহিদ হন একাত্তরে। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তার কৃতিত্ব সম্পর্কে বলা হয়, ‘পাকিস্তানি বাহিনির বিরুদ্ধে কালজয়ী সমরনায়ক সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের রণকৌশল ছিল ভিন্নধর্মী। তার প্রতিটি সমরকৌশল ছিল গণমুখী ও সৃজনশীল।'

অভীক ওসমান গভীর অনুসন্ধান ও সমীক্ষায় মেজরের জন্ম, বাল্যস্মৃতি, চিঠিপত্র, ডায়েরির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা নাজমুলের চরিত্র কাঠামোর এক তথ্যনিষ্ঠ বয়ান উপস্থাপন করেছেন। গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে ব্যক্তিকে ইতিহাসের চরিত্রে রূপান্তরিত করেছিল, সে বিশ্লেষণ দিয়েছেন। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের যৌথতায় একাত্তরের জনযুদ্ধে গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের চিত্রটিও ভেসে আসে গবেষণার সূত্রে।

একজন জাতীয় বীরের জীবনালেখ্য ও অবদানের এমন সজিব ও সচল চিত্র দেশের ইতিহাসের পাতাগুলোকেও পুষ্ট করে। একটি সংগ্রামী জাতির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃত্বের সম্মিলনে জাতীয় জাগরণ ও জনযুদ্ধের ঐতিহাসিক ক্যানভাসটিও প্রতিস্ফূট হয়।

অভীক ওসমান জানাচ্ছেন, ‘সত্তর দশকের ক্রমবর্ধিষ্ণু চট্টগ্রামের নগরায়নের বাঁকে বাঁকে বিকশিত হয়েছিল জাতীয়তাবাদী চৈতন্য। পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে কলেজে, রাজনৈতিক দলের অফিসে, নেতাদের তৎপরতায় বাংলাদেশের পক্ষে বাড়ছিল জনসম্পৃক্ততা। একটি শোষণমূলক রাষ্ট্রকে অবলীলায় অস্বীকার করে জাতিসত্ত্বার মানসে জাগ্রত হচ্ছিল বাংলাদেশের অভিব্যক্তি, রক্তাক্ত রণাঙ্গণের মধ্য দিয়ে যা অবশেষে অর্জিত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে সমষ্টি পর্যন্ত প্রসারিত এবং আন্দোলন থেকে সশস্ত্র যুদ্ধ পর্যন্ত কেন্দ্রিভূত সেই ইতিহাসের গতিপথ ও পরম্পরা যদিও অতীতের অংশ, তথাপি তা আমাদের ভবিষ্যতের পথনির্দেশকও বটে।’

‘আমাদের কৈশোর, যৌবন বেড়ে উঠেছিল যে আন্দোলনমুখর জাতীয় ইতিহাসের স্রোতধারায়, তা-ই মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণের বিজয়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতমুখী বাংলাদেশের চিরউন্নত কাঠামোর নির্মাণসূত্র’, বলেন অভীক ওসমান, ‘বিশেষত ঐতিহাসিক চট্টগ্রাম বাংলার আন্দোলন, সংগ্রাম ও অর্থনীতির সূতিকাগার। বন্দর, শিল্প, বাণিজ্য, বিশ্বায়ন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের স্তম্ভ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চট্টগ্রাম উজ্জ্বল বাতিঘরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশ ও বিশ্বের সামনে।’

ব্লু ইকোনমি ও পূর্বমুখী অর্থনীতির সূত্র ধরে অভীক ওসমান বলেন, ‘চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক জোন, ইস্পাত ও লৌহ শিল্প, মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি পরিপুষ্ট করতে পারে। বাংলাদেশকে উন্নততর অবস্থানে এগিয়ে নিতে হলে এসব সেক্টরকে গড়ে তুলেই তা করতে হবে।’

স্বাপ্নিক ও চিন্তক অভীক ওসমান মনে করেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয় জাগরণে চট্টগ্রাম ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে যেভাবে সামনের কাতারে এগিয়ে এসেছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা-জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায়ও চট্টগ্রাম থাকবে সম্মুখ সারিতে।’

জাতীয় কবি কাজী নজরুলের দীপ্ত উচ্চারণের আলোকে অভীক ওসমান বিশ্বাস করেন, ‘জাতীয় জাগরণের চাঁদ উদিত হলে জনস্রোতের প্লাবন যেমনিভাবে থামানো সম্ভব নয়, উন্নয়নের চন্দ্রালোক বিচ্চুরিত হলে নির্মাণ ও অগ্রগামিতার মহাযাত্রাকেও তেমনিভাবে আটকে রাখা সম্ভব নয়। একাত্তরে স্বাধীনতাকামী যে বাংলাদেশকে কেউ থামাতে পারে নি, আজকের উন্নয়নকামী বাংলাদেশকেও কোনো শক্তি আটকে রাখতে পারবে না।’

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর