বাংলাদেশে পাওয়া পাখিদের আবাসিক এবং অনাবাসী হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। বেশিরভাগ পরিযায়ী পাখিদেরই অনাবাসী হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
বাংলাদেশে প্রায় ৭১২ প্রজাতির পাখি রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩২০ প্রজাতি পরিযায়ী। তাদের কিছু শীতকালে উড়ে আসে; আবার কিছু প্রজাতি সারা বছরই থাকে।
সরকারিভাবে মে মাসের দ্বিতীয় শনিবার বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস হিসেবে পালিত হয়। সে ধারাবাহিকতায় বৈশ্বিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকারীরা আজকের দিনটিকে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালন করছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘পোকামাকড় রক্ষা করো, পাখি রক্ষা করো’।
তাই, পাখির স্থানান্তরের বর্তমান প্রবণতা, পোকামাকড়ের ওপর তাদের নির্ভরতা এবং ব্যাপকভাবে কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব, বিশেষ করে বাণিজ্যিক কৃষিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা সময়োপযোগী বলে ধারণা করা হয়।
এ-বছর ফেব্রুয়ারিতে, কনভেনশন অন দ্য কনজারভেশন অব মাইগ্রেটরি স্পিসিস অফ ইল্ড অ্যানিমেলস (সিএমএস) একটি যুগান্তকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য চুক্তি নিয়ে একটি সতর্কতামূলক পর্বও ছিল।
প্রতিবেদনে পরিযায়ী পাখির মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে নির্দেশ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, পাখি শিকারকে এর পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে পরিযায়ী পাখিদের জন্য একটি স্বাগতিক দেশ হওয়ার কারণে প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কতা বলে মনে হয়েছে।
গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় কৌশলগত অবস্থান এবং এর গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ পরিযায়ী পাখিদের জন্য বেশ উপযুক্ত। বাংলাদেশ একটি আবাসযোগ্য স্থান হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে জলপাখি এবং তীরে বসবাসকারী পাখিদের জন্য বাংলাদেশের প্রকৃতি ভীষণ অনুকূল পরিবেশ এবং আবাসযোগ্য স্থান হিসেবে বিবেচিত।
এই পাখিরা বিশ্রাম এবং প্রজননের জন্য শীতকালীন স্থানগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট রুট মেনে চলে, যা ফ্লাইওয়ে নামে পরিচিত। বাংলাদেশ দুটি প্রধান পরিযায়ী পাখির ফ্লাইওয়ের মধ্যে অবস্থিত; পূর্ব-এশীয় অস্ট্রেলিয়ান ফ্লাইওয়ে এবং মধ্য এশিয়ান ফ্লাইওয়ে।
গত বছর প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, টাঙ্গুয়ার হাওর পরিযায়ী পাখিদের আবাসনের জন্য অন্যতম প্রধান জলাভূমি। কিন্তু এখান থেকেও ধীরে ধীরে অনেক জলপাখি হারিয়ে যাচ্ছে।
শিকার এবং চোরাচালানকে বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিদের জন্য একটি বিরাট হুমকি বলে সমর্থন করে অসংখ্য সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে পরিযায়ী প্রজাতির পাখিদের খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। তাই এ কারণটিও আরেকটি বড় হুমকি হিসেবে স্বীকৃত হওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একজন অনুষদ এবং ওয়াইল্ডটিম বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী প্রফেসর মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পাখিদের খাদ্য শৃঙ্খলকে ভারসাম্যহীন করার জন্য বিষাক্ত কীটনাশক এবং কীটনাশকের চিন্তাহীন প্রয়োগ দায়ী।
পাখিরা বিভিন্ন ধরনের খাবার খায়। খাদ্যাভ্যাসের ওপর নির্ভর করে। পাখিদেরকে ফ্রুগিভোরাস, ফলিভোরাস, হারবিভোরাস, নেক্টারিভোরাস এবং কীটপতঙ্গ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। তাদের খাদ্যাভ্যাস যাই হোক না কেন, প্রতিটি পাখি অবশ্যই পোকামাকড়ের ওপর নির্ভরশীল। পোকামাকড় হল প্রোটিনের সর্বোত্তম উৎস। অন্তত বাচ্চাদের লালন-পালন করার জন্য একটি মা পাখির পোকামাকড় খাওয়ানোর প্রয়োজন হয়। মাছি, মৌমাছি, শামুক, মাকড়সা, সেন্টিপিডস, মিলিপিডস, কাঁকড়া এবং পতঙ্গের মতো অমেরুদণ্ডী বা অ্যার্থ্রোপোডা পর্বের বিভিন্ন প্রাণি পাখিদের পছন্দের খাবারের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু প্রতি বছর ০.৯২ শতাংশ এবং প্রতি ১০ বছরে ৮ দশমিক ৮১ শতাংশ হারে পোকামাকড় হ্রাস পাচ্ছে, যার ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিযায়ী পাখি ও প্রকৃতি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সাজেদা বেগম উল্লেখ করেন, পোকার প্রাচুর্য কমে যাওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে কৃষিক্ষেত্রে কীটনাশক, কীটনাশক ও বিষাক্ত সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার।
একজন প্রাযুক্তিক পর্যালোচক হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আইইউসিএন রেড লিস্ট অফ বার্ডস তৈরিতে অবদান রেখেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন, কীটনাশকের সংস্পর্শে থেকেও বেঁচে থাকা পোকামাকড় খাওয়ার ফলে পাখির প্রজনন চক্র ব্যাহত হতে পারে। পাখির ছানারাও তীব্র বিষাক্ততায় ভুগতে পারে।
শীতকালে বাংলাদেশে আগত পরিযায়ী পাখিদের কীটনাশক কীভাবে প্রভাবিত করে?
পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ, এশিয়ার কিছু অংশ এবং হিমালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে উড়ে আসে। বাংলাদেশকে তাদের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার না করা সত্ত্বেও কীটপতঙ্গের প্রাচুর্য তাদের সুস্বাস্থ্য ও প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সাজেদা বেগম ব্যাখ্যা করে বলেন, পরিযায়ী পাখিরা প্রোটিন হিসেবে পোকামাকড় খায়। তাদের প্রকৃত বাসস্থান ফিরে পাওয়ার পর তারা প্রজননের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে। সেসময় পোকামাকড় খেয়ে তারা শক্তি সঞ্চয় করে। অনেক পরিযায়ী পাখি বিশেষ করে জলজ প্রজাতি পোকামাকড়ের ওপর খুব বেশি নির্ভর করে। জলাভূমিতে আশ্রয় এবং উপকূলে চারণের পাশাপাশি পোকামাকড়ই তাদের শক্তি, গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
সাজেদা বেগম আরও বলেন, জলাশয়ের বিষাক্ত দূষণ জলজ পোকামাকড়দের ধ্বংস করে যা দিনশেষে পরিযায়ী পাখিদেরও প্রভাবিত করে। কৃষিক্ষেত্র এবং শিল্প অঞ্চল থেকে বিষাক্ত উপাদান শেষ পর্যন্ত যেন জলাভূমিতে না মিশে, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
এক সমীক্ষায় দেখা যায়, কীটনাশক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সঠিক জ্ঞানের অভাব ব্যাপক এবং অত্যধিক কীটনাশক প্রয়োগের প্রবণতা রয়েছে। সমীক্ষাটির ১৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, কীটনাশক উপকারী পোকামাকড় এবং প্রাণিদের হত্যা করে। অন্যদিকে, ৬ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) কীটনাশক সম্পর্কে বলে, কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে পানি দূষিত হয়; যার ফলে উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষতি হতে পারে। কীটনাশক মাটিকে দূষিত করে জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
আশার সংবাদ হলো, সম্প্রতি খাদ্য ও কৃষি সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে কীটনাশক ব্যবহারের নিয়ম সম্পর্কে সুপারিশমালা প্রদান করেছে। এই বছরের মার্চ মাসে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কাছে সে সুপারিশমালা হস্তান্তর করা হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে সুপারিশগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করবেন বলে এখন আশা করা যায়।