প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল, রং আর ভেজালের ভিড়ে রংপুরে সাড়া ফেলেছে ভ্রাম্যমাণ ঘানি তেলের গাড়ি। পথে পথে গাড়ি থামিয়ে সরিষা আর কালোজিরা থেকে তৈরি হচ্ছে তেল। ক্রেতারা দাঁড়িয়ে থেকেই দেখছেন তেল তৈরির প্রক্রিয়া। হাতের নাগালে উন্নতমানের ভেজালমুক্ত ঘানির তেলের বিক্রিও বাড়ছে দিন দিন।
ভ্রাম্যমাণ ঘানি তেলের বাজারজাতকরণে ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নিয়েছে রংপুরের সাতগাড়া এলাকার বাসিন্দা এম এ রশিদ। বর্তমানে তার অবস্থান ঢাকায়। একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ভিডিও এডিটিং এবং পত্রিকাতে খন্ডকালীন চাকরির পাশাপাশি তরুণ এ উদ্যোক্তা ঘানি তেলের গাড়িতে ঘুচিয়েছেন কয়েকজন বেকারের হতাশা। তার এ ধরণের ভ্রাম্যমাণ কারখানায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে অনেকরই। আর ক্রেতারাও খুশি চোখের সামনে তেল তৈরি করে নিতে পেরে।
কয়েক মাস ধরে রংপুর মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়ছে খাঁটি সরিষার ভ্রাম্যমাণ ঘানির তেল মেশিন। কারখানার সরঞ্জাম বলতে ড্রাম, মগ, গামলা, খালি প্লাস্টিক বোতল, খৈল (খলদি) রাখার বস্তা এবং ৩-৪ জন কর্মী। তাদের কেউ সরিষা ঢেলে তেল তৈরি করছেন। কেউ প্লাস্টিক বোতলে তেল ভরছেন আর কেউ বা নিচ্ছেন ক্রেতার হাতে থেকে টাকা।
নগরীর টেক্সটাইল মোড়ে ভ্রাম্যমাণ এই তেল কারখানার অন্যতম উদ্যোক্তা এম এ রশিদের সাথে কথা হয়। তরুণ এ উদ্যোক্তা জানান, গত বছরে আড়াই লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করেন। প্রতি এক মণ সরিষা থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৪ কেজি তেল বের হয়। কেজি প্রতি তেল ২৪০ টাকা করে বিক্রি করেন। সরিষার নির্যাস মেশিন চেপে তেল করে দেওয়ার পর বাকি খৈলে পরিণত হয়। মেশিনের তাপেই খৈল শুকিয়ে যায়। যা মাছ, মুরগি ও গরুর উৎকৃষ্ট খাদ্য।
এক কেজি খৈল খুচরায় ৩৫-৪০ টাকা বিক্রি হয়। শীতকাল ও রমজান মাসে তেল বেশি বিক্রি হয়।
তিনি আরও জানান, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা থেকে উন্নতমানের সরিষা সংগ্রহ করা হয়। এতে প্রতি মণ সরিষা ২২০০ টাকা কেনা পড়ে। সরিষার মানের ওপর নির্ভর করে তেলের পরিমাণ। ভালো সরিষার তিন ভাগের এক ভাগ তেল পাওয়া যায়। প্রতি লিটার তেল তৈরিতে ১৯০-১৯৫ টাকা খরচ পড়ে। কারিগর-শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতিদিন ২ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। জেনারেটরের ডিজেল বাবদ ১ হাজার টাকা তো স্থির খরচ আছে। এর বাইরে বোতল ক্রয়ে খরচ হয়। সব খবর বাদ দিয়ে এখন প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকার মতো আয় হচ্ছে।
মেশিনে তৈরি তেল সংরক্ষণের ব্যাপারে রশিদ বলেন, আমরা যে বোতলে তেল বিক্রি করছি তা ঘরে তিন-চার দিনে রেখে দিলে নিচে গাদগুলো শক্ত হয়ে বসে যাবে। এরপর তেলটা আরেকটি বোতলে সরিয়ে নিয়ে রোদে দিলে কমপক্ষে ৬ মাস ভালো থাকবে। যদি কয়েক মাস পরপর একটু রোদে দেওয়া যায় তাহলে এক বছরের বেশি সময় টিকবে।
তিনি জানান, দুই লাখ ত্রিশ হাজার টাকায় পাবনা থেকে সরিষার তেলের মেশিনটি তৈরি করেছি। মেশিনের মাধ্যমে তৈরি তেল বিএসটিআই অনুমোদিত। সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি নিয়ে সাড়া পেয়ে আসছি। বর্তমানে ব্যবসাও ভালো চলছে। তরুণ উদ্যোক্তারা চাইলেই এ ধরণের ভ্রাম্যমাণ কারখানা করে স্বাবলম্বী হতে পারে। এতে বেকারত্ব যেমন কমবে তেমনি মানুষও উপকৃত হবে।
ইদানীং সয়াবিন বা সানফ্লাওয়ার তেলের ব্যবহার বেশি হলেও সরিষার তেলের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। স্পেশাল রান্না, বাঙালির প্রিয় ভর্তা, চাটনি তৈরি থেকে শুরু করে শিশুদের শরীরে পর্যন্ত সরিষার তেল ব্যবহার করা হচ্ছে। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সরিষার তেলের পাশাপাশি এক শ্রেণীর প্রতারকরা নকল ও ভেজাল তেলের রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছেন। সেই ভেজালের ভিড়ে খাঁটি সরিষার তেলের স্বাদটা মানুষকে পৌঁছে দিতে এম এ রশিদের এই প্রয়াস। ক্রেতার সামনেই তেল তৈরি করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা ইতিমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।