হাত দিয়ে মাটির হাড়ি ঢং ঢং বাজনার তালে তালে ভেসে আসছে সুমধুর কণ্ঠে গাওয়া গান। অনেক দূর থেকে মানুষ আর গাড়ির শব্দ ভেদ করে স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে, মাটির হাড়ি বাজনার তালে তালে সুমধুর কণ্ঠ। বৃদ্ধ হলেও যেমনি আছে তার গানের গলা, তেমনি আছে গলায় জোরও।
একটু হেঁটে যেতেই দেখি, রাস্তার পাশে অনেক মানুষের ভিড়। তাদের মাঝে হাড়ি বাজিয়ে গান গাইছেন আর নিজের পরিচয় দিচ্ছেন গানে গানে। তার অদ্ভুত বাজনার তালে তালে গান শুনতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীরা দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন সেখানে। কয়েক মিনিটেই মানুষের ভিড় জমে গেল সেখানে।
এই অদ্ভুত বাজনা আর সুকণ্ঠের অধিকারীর নাম- জামাল।
জামাল সাতক্ষীরা আলিপুর এলাকার বাসিন্দা। পাঁচ মেয়ের বাবা তিনি। হাড়ি বাজানোর পয়সায় চলে তাদের সাতজনের পেট। সে কারণে বৃদ্ধ বয়সে এসেও পেটের দায়ে প্রতিদিন বের হয়ে পড়েন গান শোনানোর উদ্দেশে। পথে পথে গান গেয়ে যে টাকা-পয়সা জোগাড় হয়, তাই দিয়েই তাদের বেঁচে থাকার খোরাক জোগায়।
আপনি পথে পথে হাড়ি বাজিয়ে গান গাইছেন কেন, উদ্দেশ্য কী, বার্তা২৪.কমের এমন প্রশ্নের জবাবে জামাল বলেন, গান হলো শখের জিনিস! মনের আনন্দের খোরাক! মানুষ গান করে শখ করে। আমারও তেমন ছিল কিন্তু অভাব-অনটনে আজ আমি পরাজিত!
তিনি বলেন, কোনোদিন পেটে দু’মুঠো ভাত যায় আবার কোনোদিন যায়ই না। সেই সকালে বের হয়েছি মাটির এই হাড়ি নিয়ে। বাড়িতে ৫ মেয়ে। তারা বললো, বাবা হাড়ি নিয়ে কোথায় যাবে? বললাম- দেখি, ভাতের সন্ধানে যাচ্ছি। তাই বলে হাড়ি নিয়ে পথে পথে ঘুরছি। গান গেয়ে মানুষ এক জায়গায় জোগাড় করছি তাদের মন জয় করছি। খুশি হয়ে কেউ ১, ২, ৫, ১০ টাকা খুশি হয়ে যে যা দিচ্ছেন, তাই দিয়ে আমাদের পেট চলবে! এভাবে পথে পথে ভবঘুরের মতো চলছে দিন আমাদের!
আপনি এই হাড়ি বাজিয়ে গান গাওয়া কীভাবে শিখলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে জামাল বলেন, আমার ওস্তাদ আনোয়ার। তিনি জারিগান করতেন। একদিন শ্যামনগর জারিগানের মঞ্চে দেখতে পাই হাড়ি বাজিয়ে গান করছেন তিনি। তো, তারপর তার কাছ থেকে আমি এই হাড়ি বাজনা শিখেছি আর পথে পথে এভাবে এটা বাজিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি!
এদিকে, এখন জারি, সারিগান প্রায় বিলুপ্তির পথে। আগে গ্রামে-গঞ্জে প্রায়ই দেখা যেতো জারি, সারিগানের আসর। কিন্তু আধুনিকায়নের এই যুগে এসে জারি, সারিগান হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। তেমন একটা দেখা যায় না এই জারি, সারিগানের আসর।
হাড়ি বাজিয়ে জারিগান জামালের
জারিগানকে ধরে রাখতে হাড়ি বাজিয়ে গান গাওয়ার এখনো প্রয়াস করে যাচ্ছেন জামাল পথে পথে। জামালের গানের কণ্ঠ শোনামাত্র রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথচারী দাঁড়িয়ে পড়ছেন সেখানে। তার শ্রোতার যেন শেষ নেই!
রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান শুনতে থাকা মিলন বললেন, এরকম গান সচরাচর শোনা যায় না। তাই, অফিসে যাওয়ার পথে এমন গান শোনার সৌভাগ্য হলো! তাই, দাঁড়িয়ে একটু গান শুনছি! শিল্পীর কণ্ঠ অনেক ভালো এবং তিনি হাড়ি বাজিয়ে গান করছেন। হাড়িকে তিনি বাদ্যযন্ত্র বানিয়েছেন। তাতেও দেখি অনেক সুর উঠছে!
পাশে দাঁড়ানো শিক্ষার্থী আয়েশা জানালেন, আমরা নতুন প্রজন্ম শুধু মোবাইল ফোনে গান শুনি। কিন্তু এখন এই পথে এই গান শুনে খুব ভালো লাগছে আবার মজাও লাগছে! কারণ, এমন কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আগে গান শুনিনি। রাস্তায় শিল্পী জামালের গান শোনার জন্য ভ্যানচালক, রিকশাচালক, মজুর, শ্রমিক, চাকরিওয়ালা, সবাই দেখা যায় সেখানে ভিড় করছেন তার গান শোনার জন্য!