চট্টগ্রাম এমইএস কলেজের কীর্তিমান ড. খালিদ হোসেন

বিবিধ, ফিচার

ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-29 16:42:07

ঘটনাটি কাকতালীয়, নাকি দৈব-সংযোগ, আমি জানি না। বৃহস্পতিবার (৩১ জানুয়ারি) সকালে আমি তাকে ফোন করি। তার একটি প্রবন্ধ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছি আমি। বইটি বের হলে আমাকে পাঠানোর ব্যাপারে কথা বলাই ছিল ফোনের উদ্দেশ্য।

জানালেন, ‘বইটি বের হয়েছে। আমাকে সহসাই পাঠাবেন।’ ফোনের অপর প্রান্তে আলাপ-আলোচনার শব্দ শুনে জানতে চাইলাম, ‘কোথায় আছেন?’ বললেন, ‘কর্মস্থল কলেজে।’

পরে বিকালের দিকে আরেক সূত্রে জানলাম, তিনি ২৭ বছরের সুদীর্ঘ অধ্যাপনার শেষ দিনটি কাটিয়ে আজই অবসর নিচ্ছেন। অথচ কথাটি তিনি নিজের মুখে বলেন নি।

কেন বলেন নি, তার একটি কারণ এমন যে, কর্মপ্রবণ মানুষ প্রকৃত অর্থে অবসরে যান না। মৃত্যুই কেবল তাদেরকে পূর্ণ অবসর দিতে পারে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক অবসর হলেও বহু-বিস্তৃত কাজের জগৎ থেকে তার যে অবসর হচ্ছে না, এ কথা বলাই বাহুল্য।

যার কথা বলছি, তিনি প্রফেসর ড. আফম খালিদ হোসেন, চট্টগ্রামের মানুষ তো বটেই বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ইসলামিক স্কলারগণ একনামে তাকে চেনেন।

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ-খুলশী এলাকার বিখ্যাত ওমর গণি এমইএস কলেজের এই জনপ্রিয় অধ্যাপক নিজস্ব মনন ও মনীষায় ঋদ্ধ। কীর্তিমান অবয়বে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে জাজ্বল্যমান।

বছরের পুরো সময়ই তিনি সেমিনার, আলোচনা, পাবলিক লেকচারে দেশ-বিদেশে সফর করেন। আমার সঙ্গে বছরে এক-দুইবারের বেশি কথাও হয় না। উভয়ের ব্যস্ততার কারণে দেখা হয় কদাচিত। বরং তার পুত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তরুণ অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা হয় বেশি।

তিন যুগের মতো সময় চট্টগ্রামে অবস্থানের কারণে যেসব চিন্তক ও পণ্ডিতের সঙ্গে আমার সংশ্লেষ হয়েছে, তাদের মধ্যে ইতিহাসবিদ আবদুল করিম, প্রবীণ-প্রাজ্ঞজন মুঈনুদ্দীন আহমদ খান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানি আরআই চৌধুরী, ইসলামের ইতিহাসবিদ ইনাম-উল হক অন্যতম। এদের জ্ঞান পরম্পরার বিশিষ্ট ও কৃতি ছাত্র ড. আফম খালিদ হোসেনের সঙ্গেও সঙ্গত কারণে যোগাযোগ গড়ে উঠে। বিভিন্ন একাডেমিক, ধর্মতাত্ত্বিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক বিষয়ে এই লেখক, অধ্যাপক ও সম্পাদকের সঙ্গে আমার নিবিড় আলাপ-আলোচনা হয়েছে। লেখালেখির সম্পর্কও গড়ে উঠেছে নানা প্রসঙ্গে।

জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে নিয়োজিত একজন ব্যক্তির জীবনব্যাপী অবদানের পরিমাণ ও গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ নিবেদিত ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই জ্ঞানচর্চার ধারা অব্যাহত থাকে এবং বিকশিত হয়।

ড. খালিদ হোসেন একনিষ্ঠভাবে জ্ঞান ও শিক্ষার পথে এ কাজটিই করেছেন। শুধু করেছেন বললে কম বলা হবে। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে স্বীয় দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে নিজেকে এবং নিজের বিদ্যাক্ষেত্রকে আলোকিত করেছেন।

পেশাগত সাফল্যের সূত্রে কৃতিত্বের শিখর স্পর্শ করার এমন সুযোগ সবাই কাজে লাগাতে পারে না, তিনি তা দক্ষতার সঙ্গে করতে পেরেছেন। ফলে তার স্বীকৃতি ও অবস্থান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রসারিত হয়েছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ কর্মনিষ্ঠ ড. খালিদের শেষ কর্মদিবসের বিবরণ দেওয়া যায়। পেশাজীবনের শেষ দিনটিকে তিনি আলস্য ও স্মৃতিকাতরতায় নয়, প্রথম বর্ষের তাজা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দীর্ঘ ক্লাশ নিয়ে ইতিবাচকভাবে সমাপ্ত করেছেন। কাজের প্রতি নিবেদিত এই অধ্যাপক সমগ্র পেশাজীবনে একাধিক গ্রন্থ প্রণয়ন, পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করে ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিশাল ‘ইসলামি বিশ্বকোষ’-এর ৩য় থেকে ১০ম খণ্ড সম্পাদনার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

ইসলাম বিষয়ক পাঠকপ্রিয় মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করে চলেছেন বহু বছর ধরে। বাংলাদেশের এমন কোনো জায়গা সম্ভবত নেই, যেখানে তিনি বক্তব্য রাখতে যান নি। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের অন্যান্য দেশেও গিয়েছেন আমন্ত্রিত হয়ে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন তার প্রিয় কর্মক্ষেত্র ওমর গণি কলেজ, চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশের বার্তা।

প্রকৃতির ধারায় ড. আফম খালিদ হোসেন আনুষ্ঠানিক অবসর নিলেও তিনি যে জ্ঞান ও ধর্মচর্চা, গবেষণা ও বক্তৃতা, লেখা ও সম্পাদনায় অবিরাম নিয়োজিত থাকবেন, তা বিলক্ষণ বলা যায়। বরং প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাদকতা না থাকায় তিনি তার কাজ আরো গতিশীলভাবে করতে পারবেন। দেশ ও বিদেশে নিজেকে আরো প্রসারিত করতে সক্ষম হবেন।

প্রথাগত অবসর নিলেও চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে ড. খালিদ হোসেন জ্ঞান ও শিক্ষাচর্চার আলোকিত বাতিঘরের মতো অবস্থান করবেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্য লালিত এবং ইসলাম ও ইতিহাস চর্চায় নিবেদিত এই ব্যক্তিত্ব সমুদ্র ও পাহাড়ের মেলবন্ধনের নিয়ামত-আশ্রিত শক্তি ও সুষমায় ইসলামের ইতিহাসের গৌরবময় মুকুটে আরেকটি স্বর্ণের পালক সংযোজন করবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

 

 

এ সম্পর্কিত আরও খবর