একবার আদালতে ২৭৪ শব্দের একটি বাক্য নিয়ে বেশ হাস্যরস হয়েছিল। সেটি অবশ্য ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলের কথা। তিক্ত ও শ্লেষপূর্ণ অভিজ্ঞতার কারণে তেমন বাক্য গঠনের পথে পরে আর কেউ যান নি!
বাক্য জটিল করার ধারাটি বাংলা ভাষার পণ্ডিতরা অন্ধ-ইংরেজি অনুকরণের ফলে পেয়েছিলেন। উনিশ শতকে অনেক বিখ্যাত ইংরেজ লেখক লম্বা লম্বা বাক্যে তাদের বইপত্র লিখতেন। মিল্টনের রচনায় গড় বাক্যদৈর্ঘ্য ছিল ৬০ শব্দ। স্পেনসারের ৫০ শব্দ। ড্যানিয়েল ডিফোর ৬৮ শব্দ। ড্রাইডেনের ৪৫ শব্দ।
আধুনিক ইংরেজ লেখকদের মধ্যে চার্লস ডিকেন্স, প্রাউস্ট, টমাস, উলফ প্রমুখ মাঝে মঝে দীর্ঘ বাক্য লিখেছেন। এদের রচনায় বাক্যের গড় দৈর্ঘ্য বেশি নয়। এভাবে লম্বা বাক্য রচনার দিন শেষ হয়ে ছোট ছোট বাক্যে লেখার প্রচলন শুরু হয়।
আসলে ভাষা প্রবাহিত হয় শব্দ-সমষ্টি বা বাক্য দ্বারা। বর্ণ-সমষ্টি যেমন শব্দ, তেমনি শব্দ-সমষ্টি হলো বাক্য। কিন্তু সে বাক্যগুলোর গঠন যদি সুন্দর ও সাবলীল না হয়, তাহলে ভাষাও সুন্দর এবং গতিশীল হবে না।
একথা সকলেরই জানা যে, দীর্ঘ বাক্য যৌগিক ও জটিল হওয়াই স্বাভাবিক। জটিল বাক্যে মূলবাক্য, পার্শ্ববাক্য এবং তাদের মধ্যে সম্বন্ধ বুঝতে পাঠকের বেশ মানসিক কসরত করতে হয়। তাছাড়া চল্লিশ-পঞ্চাশ শব্দের একটি বাক্য বিরক্তিকর তো বটেই। এমন বাক্য হয়ত ওকালতনামা কিংবা দলিল-দস্তাবেজে চলে, প্রাত্যহিক-ব্যবহারিক জীবনে মানানসই ও সহজবোধ্য হয় না।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্যারাগ্রাফ-দৈর্ঘ্যও পাঠের আরামের উপর প্রভাব বিস্তার করে। সাধারণত কোনও লেখক একটি প্যারাগ্রাফে ছোট একটি বিষয়াংশ প্রকাশ করেন। এক প্যারাগ্রাফ থেকে আরেক প্যারাগ্রাফে যাওয়ার মধ্যে এক ধরনের বিশ্রাম এবং বিষয়ান্তরে যাওয়ার কৌশল কাজে লাগানো হয়। প্যারাগ্রাফের দৈর্ঘ্য অর্ধ-পৃষ্ঠার বেশি হলে পাঠক বিরক্ত হন। এখন আরো ছোট প্যারাগ্রাফ লেখার প্রতি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
বাক্যদৈর্ঘ্যের বিচার-বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গড়পড়তা দশ থেকে পনের শব্দের বাক্য সহজপাঠ্যতার পক্ষে অনুকূল। বাক্যের ক্ষেত্রে এটি একটি স্বীকৃত গড়দৈর্ঘ্য। তবে, লেখার মাঝে বিশেষ প্রয়োজনে এর চেয়ে ছোট বা বড় বাক্য অবশ্যই লেখা যেতে পারে। বরং ছোট-বড় নানা দৈর্ঘ্যর বাক্য থাকলে রচনায় বৈচিত্র্য আসে। ভালো লেখার জন্য বাক্যবৈচিত্র্য একটি প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত। শুধু দৈর্ঘ্য নয়, বাক্যগঠন, পদসন্নিবেশ, শব্দচয়ন ইত্যাদি বিষয়েও মনোযোগ দিয়ে বৈচিত্র্য আনয়নের চেষ্টা থাকা দরকার। সামগ্রিক রচনার কলা-কৌশল নিয়ে লেখক যত ভাবনা-চিন্তা করে কাজ করবেন, তার রচনাও তত পাঠকপ্রিয় হবে।
তবে সহজপাঠ্যতা ও পাঠকপ্রিয়তার বিষয়টি বর্তমানে চরম চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে চলেছে। আগে বইপত্র ইত্যাদি মুদ্রিত আকারের রচনাকে কেন্দ্র করে সহজপাঠ্যতা ও পাঠকপ্রিয়তার বিচার-বিশ্লেষন করা হতো। পাঠকের অবস্থান ও পরিস্থিতি মাথায় রেখেই লেখকরা বাক্যবিন্যাস করতেন এবং ভাষার গতি দ্রুত বা শ্লথ করার বিষয়টি দেখছেন। এখন সে পটভূমিকা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
এখন ছাপার বইপত্রের বদলে মানুষ কোনো রচনা পড়ছেন ই-বুকে, পিসি বা ল্যাপটপে এবং মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। আগে একজন পাঠক পড়তেন আয়েশ করে, সময় নিয়ে, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে। এখন বাসে, ট্রেনে, চলতে চলতে মানুষ কোনও কিছু পড়ে নিচ্ছেন। তার হাতে তথ্য জানার জন্য সামান্য সময় থাকলেও রস আস্বাদনের সময় মোটেও নেই। এই পরিস্থিতির তীব্রতা একজন লেখক ও পাঠকের মধ্যে বিরাট বড় একটি চ্যালেঞ্জিং সমীকরণ তৈরি করেছে।
ফলে কোনও রচনার আগেই একজন লেখককে পাঠকের সময়, ব্যস্ততা, পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কারণ, পাঠকই কোনও রচনার প্রথম ও শেষ ভোক্তা ও বিচারক। তাদের চাহিদা এবং সুবিধা-অসুবিধাই লেখক-প্রকাশকের সামনে প্রধান বিষয়। এ কারণেই লেখকদের উপর অতি দ্রুত এবং অতি সহজে তার রচনাকে উপস্থাপনের দায় এসে বর্তাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জের বিষয়গুলো অন-লাইনে বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, ৫০০-৬০০ শব্দের বেশি পড়ার মতো সময় একজন প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক পাঠক দিতে পারেন না। বইয়ের জন্য যে আঙিক বা কাঠামো হোক না কেন, অন-লাইনের কাঠামোতে এই সংক্ষিপ্তকরণ ও সহজবোধ্যতা আবশ্যিক। ফলে ভাষার মান-উন্নয়ন, গতি, বাক্য-গঠন, শব্দ-চয়ন ইত্যাদি সবকিছুই এই পরিসরকে সামনে রেখে ভাবতে হচ্ছে। এভাবেই ভাষা ও বাক্য নির্মাণে কুশলী হয়ে ভাষার গতিশীলতা আনতে হচ্ছে বর্তমান কালের তথ্য-প্রযুক্তি-নির্ভর লেখককে।