মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বেশ বিতর্কিত ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ক্ষমতা গ্রহণের পর নানা ধরনের বিতর্কিত মন্তব্য করায় সবসময় আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। শুধুমাত্র অযৌক্তিক মন্তব্য নয়, ট্রাম্প তার কর্মকাণ্ড নিয়েও বেশ উত্তাপ ছড়িয়েছেন গত তিন বছরে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান টালমাটাল থাকলেও বরাবরের মতো নিজের অবস্থান শক্ত রেখেছেন তিনি। কিন্তু শেষমেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে দাঁড়াল! নিজের করা কোনো মন্তব্য নিয়ে নয়, ফেঁসে গিয়েছেন কূটনীতি বিদ্যায় কাঁচা হাতে খেলতে নেমে।
সম্প্রতি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে করা ইমপিচমেন্ট অর্থাৎ অভিশংসন ইস্যু নিয়ে সরগরম মার্কিন আইনসভা। শুরুতে রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধিরা এটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও এখন ভুরু কুঁচকে নিন্দার ঝড় তুলছেন।
৩১ অক্টোবর অভিশংসন তদন্তের প্রস্তাব ২৩২-১৯৬ ভোটে পাস হয়েছে। কেবলমাত্র দুজন ডেমোক্র্যাট সদস্য প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। অভিশংসন তদন্ত পরবর্তী ধাপে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া হবে প্রস্তাবনাটি ছিল সেই বিষয়ে।
ইমপিচমেন্ট/ অভিশংসন কী?
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী- বেশ কিছু অপরাধের জন্য প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া অর্থাৎ তাকে ইমপিচ করা যেতে পারে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাষ্ট্রদ্রোহিতা, ঘুষ নেওয়া অথবা অন্য কোনো বড় ধরনের কিংবা লঘু অপরাধ করা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসনের ঘটনা বিরল। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চারজন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইমপিচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অভিশংসনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা অর্থাৎ কংগ্রেসে অভিশংসন ইস্যুতে উঠে আসা ব্যক্তিদের তদন্ত ও বিচারের মুখোমুখি করতে পারে।
এর আগে ১৮৬৮ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু জনসন ও ১৯৯৮ সালে বিল ক্লিনটনকে ইমপিচ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে ভোট পড়েছিল প্রতিনিধি পরিষদে। তবে সিনেটে গিয়ে আটকে গিয়েছিল এর প্রক্রিয়া। সিনেটে তাদের কাউকেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
১৯৭৪ সালে রিচার্ড নিক্সনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। যার আগেই তিনি পদত্যাগ করেন। এ নিয়ে বিশ্লেষকরা বলেন, নিক্সনের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হলে তাকে হয়তো প্রেসিডেন্টের পদ থেকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে দেওয়া হতো। যার কারণে আগে ভাগেই তিনি এ পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্ট অভিশংসনের কারণে পদ হারায়নি। প্রেসিডেন্টকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিতে হলে এই সিনেটে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিতে হবে।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ২০১৮ সালেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের করেন তারই সাবেক দু'জন সদস্য। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ট্রাম্পের সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেন। যদিও এই ঘটনা বেশি দূর পর্যন্ত গড়ায়নি।
অভিশংসনের প্রক্রিয়া
মার্কিন আইনসভার (কংগ্রেস) দুইটি কক্ষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চকক্ষ ও নিম্ন কক্ষ। উচ্চ কক্ষের নাম সিনেট (সদস্য – ১০০)। নিম্ন কক্ষের নাম হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস, (সদস্য –৪৩৫)। গেল বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ডেমোক্র্যাটরা। অর্থাৎ 'হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস'র নিয়ন্ত্রণ এখন ডেমোক্র্যাটদের হাতে। তবে মার্কিন সিনেটের নিয়ন্ত্রণে আছে ট্রাম্প প্রশাসনের রিপাবলিকান দল।
অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস অর্থাৎ নিম্নকক্ষ থেকে। সেখানে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৩৫ জন সসস্যদের মধ্যে ভোটাভুটি হয়। যেখানে পাস হলেই তবে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ধাপে সিনেটে অর্থাৎ উচ্চ কক্ষে পাস হলে শুরু হবে প্রাথমিক বিচার প্রক্রিয়া। এটা অনেকটা আদালত কক্ষের মতো, যেখানে সিনেটররা বিচারক বা জুরি হিসেবে কাজ করবেন। তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট দোষী কী নির্দোষ।
এরই প্রেক্ষিতে ৩১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন তদন্ত নিয়ে প্রস্তাব পাস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে অর্থাৎ নিম্নকক্ষে। যেখানে ২৩২ সদস্য ট্রাম্পকে ইমপিচ করার পক্ষে এবং ১৯৬ সদস্য বিপক্ষে ভোট দেন। এতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইমপিচের শুনানি ও তদন্তের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। আর কংগ্রেসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে করা ইমপিচমেন্টের তদন্তের দেখভাল করছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি।