‘সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন‘ জীবনানন্দ দাশের কবিতার এ চরণটুকু বলে দেয় জীবনের সঙ্গে পাখি আর প্রাণপ্রকৃতি কতটা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। যেখানে পাখি আছে, সেখানে প্রকৃতিতে একটা প্রাণ আছে। পাখি ও প্রকৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন এখন নওগাঁর পত্নীতলার প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী জলাশয় কাঞ্চন দিঘি। সাড়ে ১৪ একর আয়তন এ দিঘির। শীতের আগমনে দিঘিতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে অতিথি পাখির দল। এই দিঘি যেন এখন দেশি-বিদেশি পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ভোরবেলা পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙে এখানকার মানুষের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাখিদের অবাধ বিচরন, জলকেলি ও খুনশুটি কিচিরমিচির কলতানে মুখর দিঘিটি। বালিহাঁস, সরালিহাঁস, পানকৌড়ি, পিয়াংহাঁস, পাতি সরাল, লেংজাহাঁস, ছন্নিহাঁস, পাতিকূট, শামুকখোলসহ বিভিন্ন ধরনের পাখিতে মুখরিত দিঘি এলাকা। দিঘির স্বচ্ছ পানির উপর দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। সন্ধ্যা নামলেই দিঘিপাড়ের গাছগাছালিতে আশ্রয় নেয় এসব পাখি। এদের কোলাহল চারদিকে দারুণ এক দ্যোতনা সৃষ্টি করে। সেখানে উপস্থিত হলেই কেবল বোঝা যায়, এ কেমন সুন্দর ও নান্দনিক এক অপরূপ দৃশ্য। তাইতো প্রকৃতিপ্রেমীরা বৈচিত্র্যময় এ দৃশ্য দেখতে ভিড় করেন প্রতিদিন।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছর শীতে বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে শত শত অতিথি পাখি আসে। এছাড়া পাড়ার প্রতিটি গাছেই আছে দেশীয় পাখি ঘুঘু, বক, সারক, পেঁচা। সকালবেলা এসব পাখি খাবারের সন্ধানে যখন একসঙ্গে আকাশে ওড়ে, তখন সূর্য যেন আড়াল হয়ে যায়। পাখিদের কলরবে মুখর হয়ে ওঠে দিঘি পার এলাকা। আবার সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় কোলাহলপূর্ণ দৃশ্য উপভোগ করতে ভিড় জমান পাখিপ্রেমীরা। এছাড়াও পাখিদের সাথে তাদের গড়ে উঠেছে গভীর মিতালী। পাখির ডাকেই সকালে ঘুম ভাঙ্গে তাদের।
দিঘির পূর্বপারের বাসিন্দা সবিতা রানী বলেন, যখন পাখিগুলো থাকে না, খুব খারাপ লাগে, মনে হয় আর তারা ফিরে আসবে না। আবার যখন ফিরে আসে, তখন মন আনন্দে ভরে যায়। প্রতিদিন অনেকে পাখি দেখতে আসেন।
মালতি রানী বলেন, যখন পাখিগুলো থাকে, তখন পুরো দিঘি মুখর করে রাখে। আবার যখন থাকে না, দিঘিটি খালি খালি লাগে। এসব পাখি দেশের সম্পদ, এদের রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। তাই আমরা সবাই পাখিগুলোকে দেখে রাখি, যাতে কেউ পাখি শিকার করতে না পারে।
পাখি দেখতে আসা জাহিদুল ইসলাম জানান, অনেক প্রজাতির পাখি এখানে আছে। এত বেশি পাখি অন্য কোথাও দেখিনি। একসঙ্গে এত পাখি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি।
শাহেদ নামে এক দর্শনার্থী জানান, শুনলাম এই দিঘিতে নাকি অনেক পাখি এসছে। তাই এই পাখিগুলো দেখার জন্যই মূলত এখানে এসেছি। একসঙ্গে এতগুলো পাখি এর আগে দেখা হয়নি। দেখে খুবই ভালো লাগলো।
পত্নীতলা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি সুমন কুমার জানান, সারা বছরই এখানে দেশীয় প্রজাতির পাখি থাকে শীত মৌসুমে আসে পরিযায়ী পাখি। দিঘিটি লিজ দিয়ে বানিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করায় পাখিগুলো নিরাপদে থাকতে পারে না। সন্ধ্যায় আসে আবার দিনের বেলায় চলে যায়। আমাদের কমিটির পক্ষ থেকে মানুষকে সচেতন করেছি যাতে পাখি শিকার না করে।
উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, পাখি শিকার বা হত্যার ব্যাপারে সবসময় আমরা মানুষকে নিরুৎসাহিত করি। কোন পাখি আহত হলে আমরা চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকি। কেউ যাতে পাখিগুলোকে বিরক্ত করতে বা শিকার করতে না পারে সে বিষয়ে আমাদের নজরদারি আছে।