গত শনিবার দুপুর থেকে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া এলাকায় অগ্নি দুঘটনায় তিন দিনব্যাপি আগুনে ৫ একরের বেশি বন পুড়ে গেছে। এনিয়ে ২২ বছরে ২৪ বার অগ্নিকাণ্ডে ক্রমেই বিপন্ন হচ্ছে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্বঐতিহ্যের অংশ এই বন। এতবার ধুর্ঘনার পরও কেন রোধ করা যাচ্ছে এই প্রবণতা, জানতে বার্তা২৪.কম কথা বলেছে সাবেক উপ-প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে’র সঙ্গে।
বনবিভাগে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকালে তিনি কর্মরত ছিলেন সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশেও। সুন্দরবনে করমজল ও হারবাড়িয়ায় বনবিভাগের প্রকল্প বাস্তবায়নেও ছিলেন মুখ্য দায়িত্বে। সেইসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জানিয়েছেন সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের কার্যকারণ ও করণীয় সম্পর্কে। কথা বলেছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: সুন্দরবনে অগ্নিদুর্ঘটনা আসলে কি কারণে ঘটে? অতীতে দুর্ঘটনাগুলো তদন্তে কি কারণ বেরিয়েছে এসেছে...
ড. তপন কুমার দে: আপনি জানেন যে, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে খালগুলি নাব্যতা হারিয়েছে। আগে সুন্দরবনের সঙ্গে মেইনল্যান্ড ডিটাচ ছিল, এখন নাব্যতা হারিয়ে একত্র হয়ে গেছে। অতীতে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করতে স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করতে আমরা চেষ্টা করেছি। যেহেতু নাব্যতা সংকটে এখন জোয়ার-ভাটার পানি ঢুকে না সেকারণে সুন্দরীর মতা গাছগুলো কমে গেছে। তাতে ছন জাতীয় ঘাসের আধিক্য বেড়েছে। স্থানীয়রা নিজেরা ছন সংগ্রহ করে আর এটাকে গোচারণ ভূমি বানিয়ে ফেলেছে। আমার ধারণা, তারাাই আগুনাটা লাগিয়ে থাকতে পারে-যাতে ছনটা পুড়ে নতুন ঘাস হয়, তাতে গরু-ছাগল চরাতে সুবিধা হবে। এটাই মেইন কারণ। ওদের একটা ইলমোটিভ আছে। আগেও অনেকবার হয়েছে। অনেকবার বৈঠক করেছি, যাতে আগুন না দেয় কিন্তু তাদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। এটা ইন্টেনশনাললি। মৌচাকে মৌমাছি তাড়াতে আগুন দেওয়া থেকে অগ্নিকাণ্ড হলেও হয়ে থাকতে পারে-তবে ওই এলাকায় এর সম্ভাবনা কম।
বার্তা২৪.কম: তাহলে কিভাবে নিরাপদ করা যাবে সুন্দরবনকে?
ড. তপন কুমার দে: সুন্দরবানকে বাঁচাতে হলে খালগুলোর গভীরতা বাড়াতে হবে এবং মেইনল্যান্ডের সঙ্গে বনকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে। এতে বাঘের লোকালয়ে আসার প্রবণতা কমবে। কমবে স্থানীয়দের গরু চরাতে সুন্দরবনে ঢোকার অত্যাচারও। চারদিকে খাল ও নালার নাব্যতা থাকলে কোনভাবে আগুন লাগলেও ফায়ারলাইন কাটা যাবে। খালে নাব্যতার কারণে বেশিদূর ছড়াতে পারবে না। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, শরণখোলা রেঞ্জে ঢোকার মুখে বলেশ্বরে আমরা নতুন করে অনেক গাছ লাগিয়ে বনায়ন করেছি। যেখানে সুন্দরী হয় না। লোনা পানি আসে না। অন্যখানে এরকম থাকলে সেখানেও এভাবে বনায়ন করা দরকার। ঘনবন থাকলে অনেক সমস্যাই নিরসন হবে। ইতিমধ্যে সেখানে ভালো বনায়ন হচ্ছে। খাল খনন করে যদি উঁচু জায়গাতে গাছ লাগিয়ে ঘনবন সৃষ্টি করে প্রাকৃতিক পার্টিশন (খাল প্রবাহমান করে) করা য়ায় তবে লোকজন আর ঢুকবে না। ইলমোটিভগুলো আর চরিতার্থ করতে পারবে না। এটা বনের জন্যও ভালো আর আমাদের সবার জন্যও ভালো।
বার্তা২৪.কম: এ ধরণের অগ্নিদুর্ঘটনা দীর্ঘমেয়াদে সুন্দরবনের জন্য কি ক্ষতির কারণ হতে পারে?
ড. তপন কুমার দে: যেকোন ফায়ার হ্যাজার্ড হলে তো ছোটবড় বিভিন্ন প্রাণিদের জন্য ক্ষতির কারণ। পুরো ইকোসিস্টেম এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বনজ খাদ্যশৃঙ্খলে বড় রকম বিঘ্ন সৃষ্টি করে। বারবরই এখানে ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতিটা প্রটেকশন দিতে হবে। ফায়ার হ্যাজার্ড কোনভাবেই কাঙ্খিত নয়। এ এলাকায় যেহেতু অনেক আগে থেকে রেকর্ড আছে ..মূলকারণ যেটা বললাম লোকজন সেখানে গরু চরায়। লতাপাতা থাকলে যেখানে যাতায়াতে সমস্যা। বাঘের থেকে মুক্ত থাকার জন্য, গরু চরানোর জন্য স্থানীয় লোকজন এগুলো করে লাকড়ি সংগ্রহ করতে পারে। অনেকটা রামরাজত্ব কায়েমের মত ব্যাপার। আমি যখন ছিলাম তখন অনেক মামলা মোকাদ্দমা হয়েছে।
তবে এই আগুনে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে তা নয়। যদি নতুন ঘাস উঠে আর প্রটেকশন থাকে তাহলে হরিণের জন্য ভালো। যেমন জামতলা, কচিখালী-হরিণ সেখানে ঘাস খেতে পারে, ঘুরতে পারে। এই অগ্নিকাণ্ড হরিণের চারণ ভূমি হবে।
বার্তা২৪.কম: বনের ঘনত্ব বাড়াতে এই মুহূর্তে আর কি করণীয়?
ড. তপন কুমার দে: যেসব গাছে ফায়ার হ্যাজার্ড হয় না, বন্যার পানিতেও ক্ষতি হয় না যেমন রেইনট্রি, জারুল-এগুলো এখানে লাগানো যেতে পারে (আমরা আগেও ট্রাই করেছি)। এতে বনেরও উন্নতি হবে, ফায়ারহ্যাজার্ডও হবে না। এই দুইটা কাজ করতে হবে। আমি থাকলে তাই করতাম। বনের ভেতরে করমজল, হারবাড়িয়া-প্রকল্পগুলো আমার করা। আমরা গবেষণা বেশি করি, কথা বেশি বলি-কিন্তু কাজ করি না। কাজে বেশি মনযোগী হতে হবে।