বই পড়ার ফলে যে ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে, তা সম্পূর্ণ তুলনাহীন। বইপড়ুয়া মানুষেরা জানেন, এক একটা বই কতটা ভালোবাসার ও প্রিয় হতে পারে। প্রিয় বইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আনন্দ-বেদনার স্মৃতি, ভালো সময় কাটানোর অনুভূতিগুলো যেন, পৃথিবীর অন্যান্য সকল অনুভুতির কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ।
একদিকে যেমন ভীষণ বইপাগল মানুষ আছে, অন্যদিকে আছে বইকে এড়িয়ে চলার মতো মানুষও। নানান অজুহাতে বই পড়া থেকে নিজেকে দূরে রাখার মাধ্যমে তারা যে নিজেকেই বঞ্চিত করছেন, সেটা তাদের অজানা। একটি বই শুধুই কিছু শব্দের সমষ্টি নয়, একটি বই যেন একটি নতুন পৃথিবী।
যেকোন ভালো অভ্যাসই জীবনে কোন না কোনভাবে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। ভালো অভ্যাসের মাঝে বই পড়ার অভ্যাসটি অবশ্যই প্রথম সারিতেই থাকবে। যে চমৎকার ১২ টি কারণে সবার বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিৎ, সবার সুবিধার জন্য সে কারণগুলো তুলে ধরা হলো।
গবেষণা থেকে দেখা গেছে বই পড়ার অভ্যাসের ফলে মস্তিষ্কের উপর ইতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। মানসিকভাবে সবসময় উদ্দীপ্ত থাকার ফলে ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। কারণ মস্তিষ্ক সবসময় অ্যাকটিভ থাকার ফলে, তার কর্মক্ষমতা হারানোর সম্ভবনা একেবারেই কমে যায়। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের পেশীর মতোই মস্তিষ্কের পেশীকে অ্যাকটিভ রাখতে সাহায্য করে বই পড়ার অভ্যাস।
শুধু মানসিক নয়, শারীরিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে বই পড়ার অভ্যাস। এমনকি খোলা কোন স্থানে হাঁটা কিংবা পছন্দের কোন গান শোনার চাইতেও, মানসিক চাপ কমাতে বই পড়া বেশি উপকারী।
প্রতিবার নতুন এক একটি বই পড়ার সময়, আপনাকে গল্পের অনেকগুলো চরিত্র, গল্পের ব্যাকগ্রাউন্ড, গল্প ও চরিত্রের ইতিহাস, প্রতিটি চরিত্রের ক্যারেক্টারিস্টিক, গল্পের সাব-প্লট সহ আরও অনেক কিছুই মনে রাখতে হয়। কারণ, বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় গল্প মোড় নিতে থাকে। এই সকল কিছু ভালোভাবে মনে না রাখলে বইটাই তো বোঝা যাবে না। একইসঙ্গে অনেককিছু মনে রাখার অভ্যাসের সঙ্গে স্মৃতিশক্তি প্রখর হতে থাকে।
বইয়ের কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে ও কাল্পনিক ঘটনার ভেতর ডুবে যেতে চাইলে নিজেকেও হারিয়ে ফেলতে হয় সেই কাল্পনিক জগতে। গড়ে নিতে হয় নিজের একটি কাল্পনিক পৃথিবী। কল্পনা করার এই অভ্যাসের ফলে অন্যান্য আর দশজনের চাইতে ভালো কল্পনাশক্তির অধিকারী হওয়া যায়।
বিভিন্ন ধরণের উপন্যাস ও গল্পের নানান ঘটনা ও টার্ন, যেকোন পরিস্থিতিতে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার মতো মানসিক দৃঢ়তা তৈরি করে দেয়। কোন একটি গোয়েন্দা কিংবা রহস্য কাহিনী অথবা থ্রিলার কাহিনী একজন ব্যক্তিতে নানান আঙ্গিক থেকে ভাবার ও চিন্তা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাসের ফলে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার চর্চাটি বজায় থাকে।
ব্যস্ত জীবনের নানান কাজের চাপে একসাথে অনেকগুলো কাজ কিংবা মাল্টিটাস্কিং এর মাঝে থাকতে হয়। এই মাল্টিটাস্কিং এর ফলে কোন একটা কাজের প্রতি ফোকাস করার অভ্যাস কমে যায়। সেই সঙ্গে কমে যায় মনোযোগ ধরে রাখার দক্ষতা।
কিন্তু বই পড়ার সময় অন্য কোন কাজ করা সম্ভব হয় না। কারণ বই পড়ার সময় একটুও অন্যমনস্ক হলে কাহিনীর ধারাবাহিকতা হারিয়ে যায়। প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট বই পড়ার অভ্যাস কাজের প্রতি ফোকাস ও মনোযোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
রাতে ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন? চমৎকার একটি বই পড়া শুরু করুন। রাতে ঘুমানোর আগে বই পড়ার ফলে নার্ভ ও মন শান্ত হয়। ফলে খুব অল্প সময়ের মাঝেই ঘুম চলে আসে। অন্যদিকে টিভি দেখা কিংবা মোবাইল ফোন স্ক্রল করার ফলে নার্ভের উপর প্রেশার পড়ে এবং স্ক্রিনের ব্লু-রে ঘুমকে নষ্ট করে দেয়। ফলে রাতের ঘুমের সাইকেলে ব্যাঘাত ঘটে।
জীবন মানেই নানান ধরণের পরীক্ষা, চ্যালেঞ্জ। সবসময় নিজেকে সকল পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। প্রায়শ ক্লান্তিভাব চলে আসে একের পর এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হতে। এমন সময়গুলোতে প্রয়োজন হয় অনুপ্রেরণার। বইয়ের চমৎকার গল্প এক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। কাল্পনিক গল্পগাঁথা কিংবা আত্মজীবনীমূলক বই পড়লে নিজের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায়, নিজের ভুলগুলো কিংবা নিজের শক্তিগুলোকে চেনা সম্ভব হয়। এমনকি জীবনের উদ্দেশ্যকেও নির্ধারণ করা সম্ভব হয় অনুপ্রাণিত হবার মতো বই পড়ে।
নেদারল্যান্ডের এক গবেষণা থেকে গবেষকেরা দেখেছেন, অন্যান্য সকলের চাইতে বইপড়ুয়ারা কাল্পনিক চরিত্র ও গল্পের মাধ্যমে খুব সহজেই ‘ইমোশনালি ট্রান্সপোর্টেড’ অর্থাৎ আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন। কোন একটি বই পড়ার সময় বইয়ের গল্প ও চরিত্রের মাঝে নিজেকে খুব সহজেই মিশিয়ে ফেলা সম্ভব হয়। নিজেকে তখন চরিত্রগুলো আনন্দ-বেদনার অংশ বলে মনে হতে থাকে। তাদের কষ্টে চোখে পানি জমে, হাসি ফোঁটে তাদের আনন্দে। এর ফলে সহমর্মিতা বৃদ্ধি পায়। অন্যের অবস্থা ও অন্যের দুঃখ-কষ্টকে সহজেই অনুধাবন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
টিভি দেখা ও বই পড়ার মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, বই পড়ার ফলে সৃজনশীলতার ডালপাতা মনে মতো মেলা যায়। বইয়ের কাল্পনিক জগতকে নিজের মতো করে গড়ে নেওয়া, চরিত্রগুলোকে নিজের মতো সাজিয়ে নেওয়ার ফলে, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। মনকে বড় পরিধিতে উন্মুক্ত করার জন্য ও কল্পনাশক্তি বাড়ানোর জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই।
বর্তমান সময়ে সবকিছু বড্ড বেশি ডিজিটাল ঘেঁষা। ঘুরেফিরে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইলকেই বেছে নিতে হয় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। অথচ প্রতিনিয়ত এই সকল গ্যাজেট ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে চোখ, মস্তিষ্ক ও স্বাস্থ্যের উপর। অন্যদিকে বই পড়ার ফলে স্বাস্থ্যের উপর কোন নেতিবাচক প্রভাব একেবারেই দেখা দেয় না।
অবসর সময়ে সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন অনেকেই। কিন্তু সিনেমার চাইতে হাজারগুণ বিনোদনপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর গল্প থাকে একটি বইয়ে। এমনকি অনেক সিনেমা নির্মিত হয় বইয়ের গল্প অবলম্বনে। তবে বইয়ের গল্পের খুব স্বল্প অংশই উঠে আসে পর্দায়। ফলে একটি বই পড়ে যতটা ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে, অনেক সিনেমাতেই তেমনটা হয় না।
বই পড়ার হাজারো কারনের মাঝে সবচেয়ে বড় কারনটি হলো, একমাত্র বই-ই হতে পারে আপনার জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে, নিজেকে আরো পরিণত করে তোলার সুযোগটি নিশ্চয় হাতছাড়া করতে চাইবেন না কেউ।