রাজত্ব এবং রাজ্য হারা-দুটোই দেখলেন সাকিব আল হাসান ২০১৯ সালে!
কি দুর্দান্ত কায়দায় না শুরু হলো তার বছরের প্রথম এবং মাঝের ভাগটা? আর দুঃসহ যন্ত্রণায় শেষ হলো বাকিটা!
জুন-জুলাই জুড়ে বিশ্বকাপের আসরে ব্যাট-বল হাতে সাকিব আল হাসান যা করলেন সেটা তাকে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের আলোকে বিশ্ব ক্রিকেটে আরেকবার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা এনে দিল। আর বছরের শেষাংশে ২৯ অক্টোবর এসে জানা গেল সাকিবকে আইসিসি সব ধরনের ক্রিকেটে এক বছর নিষিদ্ধ করেছে! ক্রিকেট জুয়াড়ির সঙ্গে যোগাযোগ এবং তার কাছ থেকে পাওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে আইসিসিকে না জানিয়ে শৃঙ্খলা ভেঙ্গেছেন তিনি। সেই অপরাধে আইসিসি তাকে সবধরনের ক্রিকেটে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে।
একই বছরে শ্রেষ্ঠত্ব আর শাস্তি-দুটোই জুটল সাকিবের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে!
বছরের শুরুতে আইপিএলে সময়টা খুব একটা ভালো যায়নি তার। কিন্তু ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসের বিশ্বকাপে ব্যাটে-বলে সাকিব যে খেলা খেললেন সেটা অনেকে শুধু স্বপ্নেই খেলে থাকেন। সাকিব সেটা মাঠে করে দেখালেন।
৮ ম্যাচে ৬০৬ রান। ১১ উইকেট। দুটো সেঞ্চুরি। পাঁচটি হাফ-সেঞ্চুরি। পুরো বিশ্বকাপে তিনটি ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ। সেই তিন ম্যাচেই সাকিব ম্যান অব দ্য ম্যাচ! বিশ্বকাপে সেরা অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। এক বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৫০০ রান ও ১০ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব যে আর কারোর নেই!
গোটা বিশ্বকাপে সাকিবের ম্যাচ বাই ম্যাচ পারফরম্যান্সের এক ঝলক এখানে-
প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা: ৮৪ বলে সাকিব করলেন ৭৫ রান। ১ ছক্কা ও ৮ বাউন্ডারি। বোলিংয়ে ১০ ওভারে ৫০ রানে ১ উইকেট। শূন্যে ঝাঁপিয়ে একটা ক্যাচও নিলেন। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতল ২১ রানে। সাকিব ম্যাচ সেরা। ২০১৯ বিশ্বকাপে সেটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ।
প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড: বাংলাদেশের গড়া ২৪৪ রানের স্কোর কোনোমতে টপকে যায় নিউজিল্যান্ড। ম্যাচ জিতে তারা ২ উইকেটে। কিন্তু সাকিব আল হাসান ঠিকই নিজের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের উজ্জ্বলতায় ছাপিয়ে গেলেন সবাইকে। করলেন ৬৮ বলে ৬৪ রান। বাউন্ডারি ৭টি। আর বোলিংয়ে ১০ ওভারে ৪৭ রানে শিকার তার ২ উইকেট।
প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড: এই ম্যাচও বাংলাদেশ হারল বেশ বড় ব্যবধানে। কিন্তু সাকিব আল হাসান ঠিকই আলো ছড়ালেন। বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিলেন। ১১৯ বলে করলেন ১২১ রান। ১ ছক্কা ও একডজন বাউন্ডারি।
ব্রিস্টলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরের ম্যাচটা বৃষ্টিতে বাতিল হয়ে গেল। এই ম্যাচ মাঠে গড়ালেও সম্ভবত সাকিব খেলতে পারতেন না। কারণ হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে ভুগছিলেন তিনি।
প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ: টন্টনে ৩২১ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এত বেশি রান তাড়া করে বিশ্বকাপে কোনো দলের ম্যাচ জয়ের রেকর্ড নেই। কিন্তু সাকিব যেদিন খেলেন সেদিন সবকিছুই যে তার প্রভাবে পদানত। ৯৯ বলে অপরাজিত ১২৪ রান করে সাকিব সেই ম্যাচ বাংলাদেশকে এনে দিলেন ৭ উইকেটের বিস্ময়কর জয়! বাংলাদেশ যখন ম্যাচ জিতল তখনো বাকি ইনিংসের ৫১ বল! সেই ম্যাচে বল হাতেও দুর্দান্ত সাকিব। ৮ ওভারে ৫৪ রানে ২ উইকেট। এবং সাকিব আরেকবার ম্যাচ সেরা!
প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া: ট্রেন্ট ব্রিজে অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের জবাবে বাংলাদেশ থামে ৩৩৩ রানে। সাকিব এই ম্যাচে করলেন ৪১ বলে ৪১ রান। পুরো বিশ্বকাপে এক ম্যাচে এটাই সাকিবের সবচেয়ে কম রান! বাংলাদেশ সেই ম্যাচ হারল ৪৮ রানে। কিন্তু ওয়ানডে ক্রিকেটে ৩৩৩ রানের এই স্কোরই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ।
প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান: সাকিবের আরেকটি মাস্টার ক্লাস পারফরম্যান্স। স্পিন সহায়ক উইকেটে ব্যাটিংয়ে ৬৯ বলে ৫১ রান। বোলিংয়ে ২৯ রানে ৫ উইকেট। বাংলাদেশ ম্যাচ জিতল ৬২ রানে। সাকিব আল হাসান বিশ্বকাপে তৃতীয়বারের মতো ম্যাচ সেরা!
পরের দুই ম্যাচে ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ জিততে পারেনি। কিন্তু সাকিব আল হাসান ঠিকই সেই দুই ম্যাচেও হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নিলেন। বিশ্বকাপে সাকিবের ৬০৬ রান তৃতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ।
বাংলাদেশ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালের আগেই বিদায় নেয়। কিন্তু সাকিব আল হাসান ব্যাটে-বলে তার প্রভাবী পারফরম্যান্স দিয়ে ঠিকই বিশ্ব ক্রিকেটের হৃদয় জিতলেন। ফিরলেন নাম্বার ওয়ান অলরাউন্ডারের মর্যাদা নিয়ে।
এবং বিশ্বকাপ শেষেই তার বিষময় সময়ের শুরু!
সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে সাকিবের নেতৃত্বে এক টেস্টের সিরিজ হারল বাংলাদেশ। অক্টোবরে বিসিবির বিরুদ্ধে ক্রিকেট বিদ্রোহে অন্য নেতৃত্বের সাকিবকে দেখা গেল। ক্রিকেটারদের দাবি আদায়ে সোচ্চার শ্লোগানে বিপ্লবী এক নেতা ! বিসিবি ক্রিকেটারদের সেই ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ায় হাসিমুখে সাকিব তখন জয়ী এক সফল বিপ্লবী।
কিন্তু কে জানত ২৯ অক্টোবর তার জন্য কি বিশাল পরাজয় অপেক্ষা করছে?
ক্রিকেট জুয়াড়ির কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তুাব গোপন রাখা এবং সেই জুয়াড়ির সঙ্গে লম্বা সময় ধরে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ-এমন অভিযোগে সাকিব অপরাধী প্রমাণিত। নিজের অপরাধ স্বীকারও করে নেন সাকিব। আইসিসি’র দুর্নীতি দমন ইউনিটের (আকসু) দীর্ঘ তদন্তে সাকিবের অপরাধ নির্ভুলভাবে প্রমাণিত। বিধি অনুযায়ী আইসিসি তাকে সব ধরনের ক্রিকেটে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে।
আপনি এই রিপোর্ট যখন পড়ছেন তখনো সাকিব নিষিদ্ধ। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর তার এই নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে।
ক্যারিয়ারের লগবুকে ২০১৯ সালকে সাকিব দুটো শব্দে ভাগ করতে পারেন-সাফল্য ও শাস্তি!