বছর জুড়ে পুঁজিবাজারে ছিল প্লেসমেন্ট কেলেঙ্কারি

  • মাহফুজুল ইসলাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

২০১০ সালের মহাধসের নয় বছর পর ২০১৯ সাল ছিলো পুঁজিবাজারের ইতিহাসে আরেক দফা ধসের বছর। এই বছর ছোট-খাটো ৯-১০টি ইস্যু থাকলেও সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ছিল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত-অতালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর প্লেসমেন্ট বাণিজ্য।

গত আট-নয় বছরে ৮০টির বেশি কোম্পানি প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিওর) মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অন্তত ৪০-৪৫হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। আর দেশের পুঁজিবাজারে এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের দুজন সাবেক পরিচালক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) যোগসাজশে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ২০০৯-১০, ২০১১ সালে নবী উল্লাহ নবীর নেতৃত্বে ‘গ্রীন বাংলা’ নামক প্রতিষ্ঠানে প্লেসমেন্ট বাণিজ্য হয়েছিলো। এই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাতে ১ লাখ ৫০ হাজার নতুন বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজার ছেড়েছেন।

কেবল প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের ইস্যুতেই ডিএসইর সঙ্গে বিএসইসি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ায় রাস্তায় নামে বিনিয়োগকারীরা। শুরু হয় নতুন করে আইপিওর অনুমোদন বন্ধ রাখার অন্দোলন। এর ফলে কমিশন ২০১৯ সালে প্রায় ৯ মাস আইপিওর অনুমোদন বন্ধ রাখে। ফলে ২০১০ থেকে ২০১৯ এই ৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম কোম্পানির আইপিওর অনুমোদন দেয় বিএসইসি। এই বছর ৮টি কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে ৬৪১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করে।

বিজ্ঞাপন

নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসইর পরিচালক বার্তা২৪.কমকে বলেন, পুঁজিবাজারের এই অবস্থার মূল কারণ কেবল অনৈতিক প্লেসমেন্ট বাণিজ্য। প্লেসমেন্ট বাণিজ্য না হলে, কোনো ইস্যু পুঁজিবাজারকে ‘ঘায়েল’ করতে পারতো না। বিদেশিরা বাজার ছাড়তো না। দেশি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজার বিমুখ হতেন না।

তিনি বলেন, এই ইস্যুতেই ডিএসইর সঙ্গে বিএসইসি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। সব যোগ্যতা থাকার পরও কে এ এম মাজেদুর রহমানকে ডিএসইর এমডি হিসেবে মনোনীত করেনি বিএসইসি। ডিএসইর শেয়ার ব্যবসা কমাতে নতুন আরেকটি স্টক এক্সচেঞ্জ গঠনের উদ্যোগ নিচ্ছে কমিশন। আর ডিএসই ও কমিশনের দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে পুঁজিবাজারের মর্যাদা। এরপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুঁজিবাজারে।

বিএসইসির তথ্য মতে, ১১ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে পুঁজিবাজারে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে সর্বনিম্ন অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বছরে বাজারের মাধ্যমে ৬৪১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। যার পরিমাণ ২০১৮ সালেও ছিল ৬৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ হিসাবে বছরের ব্যবধানে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ কমেছে ১৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। তবে এই ব্যবধানটা অনেক বড় হতে পারত, যদি রিং সাইন ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানিটি একাই ১৫০ কোটি টাকা উত্তোলন না করত।

ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, আইপিওতে ভালো ও মন্দ উভয় কোম্পানি আসে। ডিসক্লোজারস ভিত্তির আইপিওতে অনেক ফাঁকফোকর থাকার সুযোগে কিছু দুর্বল কোম্পানি পুঁজিবাজারে চলে এসেছে। তাই বলে আইপিও বাজারে আসা বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ করতে হবে মন্দ আর্থিক প্রতিবেদন।
তবে আশার কথা হচ্ছে, ডিএসই এরই মধ্যে একটি আইপিও রিভিউ টিম গঠন করেছে। এই রিভিউ কমিটির প্রধানতম কাজ হবে প্রসপেক্টাসে প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যাদি ও আর্থিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে অবজারবেশন দেওয়া। যা পরবর্তীতে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে কমিশনে প্রেরণ করা হবে। যা বিএসইসির আইপিও অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

বাজার চিত্র: ইতিবাচক ধারায় নতুন বছরের শুরু থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হয়। এরপর জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির ঘোষণাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সূচক পতন। তার সঙ্গে যোগ হয় দুর্বল কোম্পানির শেয়ার পুঁজিবাজার থেকে তালিকাচ্যুত করার উদ্যোগ।

এরপর লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বৃদ্ধি হয় জেড ক্যাটাগরির এমন কয়েকটি কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে। শুরু হয় ডিএসইর ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপ। তার সঙ্গে নতুন করে যোগ হয় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে সব বিনিয়োগকারীদের টিআইএন নম্বর বাধ্যতামূলক করবে এনবিআর।

এরপর অর্থমন্ত্রী বললেন, পুঁজিবাজারের অবস্থাকে আমি খারাপ বলবো না। এটা ঠিক আছে, ভালো আছে। পুঁজিবাজারে এখন কোনো প্রবলেম নেই। আমি তো পুঁজিবাজারের অবস্থা ঠিকই আছে দেখলাম।

তিনি পুঁজিবাজার নিয়ে বলেন, পুঁজিবাজারে কাউকে জোর করে আনতে পারবেন না। কেউ আসতে চাইলে আসবে। না আসলে নাই। মার্কেট খারাপ আমরা দেখি না। এখানে মার্কেট চলে আপনাদের দ্বারা। আপনারাই চালাচ্ছেন। আপনারা যেভাবে চালান মনে হয় যেনো বাজারই নেই। যেভাবে একে (অঙ্কন করে) দেখান তাতে মনে হয় বাংলাদেশে শেয়ার মার্কেটেই নেই। কি যে একে দেখান তা আমি বুঝিনা। এমন বক্তব্যের পর বাজারে আরও বেশি দরপতনে নিমজ্জিত হয়।

এগুলো কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আসে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা। অর্থমন্ত্রী এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করেন বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেওয়া হবে। এরপর বাজেট ঘোষণাতে বেশ কিছু প্রণোদনাও দেওয়া হয়। কিন্তু বাজেটে কোনো কোম্পানির বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিলে কোম্পানিগুলোকে ১৫ শতাংশ কর প্রদান করতে হবে এমন প্রস্তাবের পর আবারও শুরু হয় দরপতন।

ঠিক এই সময়ে অর্থমন্ত্রী আবারও বলেন, পুঁজিবাজার ছাগল ও সিংহের বাজার। এখানে ছোট বিনিয়োগকারীদের ছাগল আর বড় বিনিয়োগকারীদের সিংহের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, এই বাজারে ৫০ কোটি নয় আরও ৫ লাখ কোটি টাকা দিলেও খেয়ে ফেলবে। এখানে ৫-১০ লাখ কোটি টাকার দিয়ে কোনো লাভ নেই। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর শুরু হয় দরপতন।

তার সঙ্গে যোগ হয় নতুন করে বকেয়া পাওনা গ্রামীণফোনের সঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির দ্বন্দ্ব। আর এই দ্বন্দ্বের ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ছাড়ার হিড়িক পড়ে।