ঈদের আগের দিন কোরবানির প্রাণী কেনার জন্যে হাটে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। প্রচুর গরু, ছাগলও অসংখ্য; কিন্তু ক্রেতা কম। কোনো কোনো হাটে খামারি-ব্যাপারিদের কাঁদতে পর্যন্ত দেখা গেল! তারা যে দামে প্রাণী কিনেছেন, বড় করেছেন, মোটাতাজা করেছেন তার দাম শেষ দিনে এসে একেবারে মুখ থুবড়ে পড়লো।
অন্যান্য বার হয় এর উল্টো। শেষ দিনে খামারি-ব্যাপারিরা দাম আরও বাড়ায়, ক্রেতারা অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনো পথ পান না। এবার এমন হবার মূল কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শত শত গরু মোটা-তাজাকরণ খামারে প্রচুর গরু প্রস্তত ছিল কোরবানির হাটকে লক্ষ্য করে।
হুজুগে মানুষ। একসময় ফটোস্ট্যাট মেশিনের চল হয়েছিল বলতে গেলে ঘরে ঘরে। ফলে ১০ টাকা প্রতি কপি ফটোস্ট্যাটের দাম নেমে আসে ১/২ টাকায়। ২০১৮'র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের হাটে গরুর দাম পতনের নেপথ্য কারণ অনেকটা ওই রকমই। দেশের আনাচে-কানাচে ফটোস্ট্যাট মেশিনের দোকানের মতো গরু মোটা-তাজাকরণ খামার গড়ে উঠেছে, লাখ লাখ গরু ক্ষতিকর ইনজেকশন দিয়ে মোটা-তাজাকরণ চলছে। সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ভারতীয় গরু, ফলে দামের খেলায় এবার চূড়ান্ত পরাজিত হয়েছেন খামারি-ব্যাপারিরা।
হাটের শেষ দিন মধ্যরাতে প্রবল বৃষ্টি কফিনে যেন শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। এসব কারণে ক্রেতা কম-প্রাণী বেশি অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় ডিম্যান্ড-সাপ্লাই তত্ত্ব অনুযায়ী অনিবার্যভাবে চোখের পানিতে ভাসে কোরবানির প্রাণীর হাট।
এ পরিস্থিতি থেকে তাহলে মুক্তির উপায় কি? কিভাবে খামারি-ব্যাপারিরা আর্থিক ক্ষতি কাটাতে পারবেন? ভেবেছি বিষয়টি নিয়ে, যাকে বলে হোমওয়ার্ক করেছি বললেও ভুল হবে না। এরকম ঋণাত্মক পরিস্থিতিকে লাভজনক করে তুলতে পারবেন আমাদের খামারিরাই। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেকাজে খুব বেশি কিছু করার বাকিও নেই! শুনতে কেমন আশ্চর্য লাগছে তাই না?
গার্মেন্টস সেক্টরে যেমন কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি বিশ্বের নামকরা বায়ারের অর্ডার পায়, ঠিক একইভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা গরু মোটা-তাজাকরণ খামারগুলোকে কমপ্লায়েন্স খামারে রূপান্তর করতে হবে। পারমিসেবল লেভেল বা মানব স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর নয় এমন পরিমাণ কেমিক্যাল ব্যবহার করে প্রধানত প্রাকৃতিক উপায়ে ও হাইব্রিড পদ্ধতিতে বৃহদাকার গরু ও ছাগল উৎপাদন করতে হবে। তবে তার লক্ষ্য শুধু কোরবানি হবে না, তার প্রধান লক্ষ্য হবে মাংস রফতানি।
বিশ্বে এখনো সুলভে প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর প্রধান উৎস গরুর মাংস বা বিফ। প্রতিবেশী ভারত পৃথিবীর প্রধান গোমাংস রফতানিকারক দেশের তালিকায় শীর্ষ পর্যায়ে। বাংলাদেশও এই সেক্টর থেকে বহু বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারে। অন্য উদ্দেশ্যে হলেও অবকাঠামো গড়ে উঠেছে অনেক ‘ব্লেসিংস ইন ডিসগাইস’ ভিত্তিতে। এখন দরকার ফাইন টিউনিং। তা করা গেলে টেকঅফ সম্ভব বিশাল বাজারের দিকে। একাজে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একা খুব একটা কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। বিশাল বাজারের সম্ভাবনা ও কমপ্লায়েন্স বিষয়াদি হ্যান্ডল করে অভ্যস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকে খামারিদের সহায়তায় যুক্ত করতে হবে। গোমাংস হতে পারে চিংড়ির চেয়েও বড়, এমনকি তা ছুঁতে পারে গার্মেন্টসকেও! আর তা হলে সেদিন আর কোনো খামারি-ব্যাপারিকে চোখের জল ফেলতে হবে না, বরং সে চোখে জ্বল জ্বল করবে ডলার উপার্জনের ঝিলিক...।
লেখক: সম্পাদক, অর্থকথা