কোন অভিমানে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে ছিল ছেলেটি?

  • আনিসুর বুলবুল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শক্ত করে ধরে রাখা দুই হাতের মুঠির মধ্যে আসলে কী আছে?

শক্ত করে ধরে রাখা দুই হাতের মুঠির মধ্যে আসলে কী আছে?

সন্ধ্যা ৭টা। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। হালকা শীত। আড়াই বছরের ছেলে আয়ানকে নিয়ে টিভি দেখছি। একটু পর জরোসরো হয়ে কাছে এসে আয়ান জানতে চায়, বাবা এটা কীসের শব্দ? টিভির শব্দ মিউট করে বুঝতে পারি কান্নার শব্দ। ড্রয়িং রুমের ব্যালকোনিতে গিয়ে দেখি আশপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজনও বুঝতে চেষ্টা করছেন কোন বাসা থেকে আসছে শব্দটি। ক্রমেই বাড়ছে কান্নার আওয়াজ! বুক ফাটিয়ে কান্না।

চা হাতে বউ এসে বলে, এ কান্না সাধারণ কান্না নয়, এটি নিশ্চয় স্বজন হারানোর কান্না। দ্রুত নিচে গিয়ে খোঁজ নাও। বউয়ের কথা শুনে বুকটা ধুক করে ওঠে। কার স্বজন চলে গেলো এই বৃষ্টি দিনে! আমার আর চা খাওয়া হয় না। দ্রুত ট্রাউজার পরে রওয়ানা হই। লিফটের ভরসা না করে সিঁড়ি দিয়েই নামতে থাকি।

বিজ্ঞাপন

পাঁচ তলা থেকে চার তলা নামতেই, ক্রমেই কান্না আর দরজা ধাক্কার শব্দ বেড়েই যাচ্ছে। তিন তলা আর দোতলা যেতেই হৈহুল্লোড় আর নিচতলা যেতেই দেখতে পাই মানুষে বোঝাই করিডোর। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক! কি হয়েছে? জানতে চাওয়া মাত্রই কেয়ারটেকার বলেন, ঝুলে রইছে ছেলেটি! মানে? প্রশ্ন করতেই তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন করিডোরের পাশেই একটি জানালার কাছে।

জানালা দিয়ে তাকাতেই আমার বুকের কোথাও চিন চিন করে ওঠে। গ্রিলিরের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে রয়েছে একটি ছেলে। গলায় গামছা; হাত দুটির মুঠো শক্ত করে রাখা। ওই পাশে দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা আর গগণ-বিদারি কান্নার শব্দে আমার সম্মিত ফিরে আসে। আমি কেয়ারটেকারকে দ্রুত গ্রিল কাটার মেশিন আনতে বলি।

বিজ্ঞাপন

এই সময়ে কি করা যায়? এদিক সেদিক পায়চারি করে ভাসানটেক থানায় ফোন দিই। কিন্তু ফোনের নম্বরটি বন্ধ পাই। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯ এ ফোন দিই। তাদেরকে লোকেশন ভাসানটেক থানার কথা বলা হলেও তারা আমাকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় এড করিয়ে দেন। ঘটনা বলার পর তারা পুলিশ পাঠাচ্ছে বলে জানান।

বাগানবাড়ির এই বাসায় প্রায় দুই বছর ধরে থাকি। এর আগে কি আমি ছেলেটিকে দেখেছি? চেনার চেষ্টা করি। কিন্তু মনে করতে পারি না। করিডোরে পায়চারি করতে থাকা এক ছেলে আমাকে জানান, ছেলেটির নাম মেহেদি। তার ফুপাতো ভাই। ইংলিশ সাবজেক্ট নিয়ে এবার ইউনিভার্সটিতে ভর্তি হয়েছে। এখানে মায়ের সঙ্গে থাকে, তার বাবা দুই বছর আগে মারা গেছেন। বিকেলে কি নিয়ে যেন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে মেহেদির।

এরই মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থানার একজন এসআই আমাকে ফোন দেন। আমি তাকে লোকেশনের কথা জানালে তিনি আমাকে ওয়েটিংয়ে রেখেই ওয়্যারলেসে ভাসানটেক থানায় ইনফরম করেন।

এই সিচুয়েশনে আসলে কি করা দরকার? বাগানবাড়ির ইউনাইটেড হোমসে প্রায় ৪০টি ফ্ল্যাট। অনেকেই নিচের করিডোরে চলে এসেছেন; সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আরো পরিচিত অনেকেই। আমি পায়চারি করছি। হালকা শীতের মধ্যেও ঘেমে একাকার হচ্ছি।

মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উশকো খুশকো চুল, কালো রঙের ফুল স্লিপ টিশার্ট আর ক্যামোফ্লেজ কার্গো প্যান্ট পরা ছেলেটির সেই ঝুলে থাকার দৃশ্যটি মাথা থেকে সরাতে পারছি না। ছেলেটি কি এখনও বেঁচে আছে? তাহলে দরজা খুলতে না পারা কিংবা জানালার গ্রিল কাটতে না পারার জন্য তো আমরা দায়ী? আমি দৌড়াতে থাকি গ্রিল কাটার মেশিনের খোঁজে।

ফ্ল্যাট মালিকদের পরিচিত অনেকেই বলেন, ঘটনা ঘটেছে অনেক আগে। ছেলেটি এতোক্ষণ আর বেঁচে নেই। পুলিশ আসার পরই দরজা খোলা উচিত। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রই। বুকের ভেতর কোথায় যে চিন চিন করছে বুঝতে পারি না। পাঁচতলার সাজ্জাদ ভাই এসে জানতে চান? কি হয়েছে? তাকে কিচ্ছুই বলতে পারি না। পা কাঁপতে থাকে।

এই সময়ে আসলে কি করার আছে? ভাবতে ভাবতেই পুলিশের গাড়ি চলে আসে। মেহেদির সেই ক্যামোফ্লেজের কার্গো প্যান্ট, ফুল হাতায় সাদা স্ট্রেপের টিশার্ট আর খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ফাঁকে শক্ত করে ধরে রাখা দুই হাতের মুঠির মধ্যে আসলে কী আছে? রাজ্যের যত রাগ? যত অভিমান? যত ক্ষোভ? যত হতাশা? আমি হিসাব মিলাতে পারি না!