৩১ মে: বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস
নিশ্চিত ক্ষতি জেনেও বেশি মুনাফায় ‘বিষবৃক্ষ’ চাষ গাইবান্ধায়!
৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের এবারের প্রতিপাদ্য ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’- যা প্রত্যেক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর ম্যাসেজের মাধ্যমেও এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া প্রতিবছরই এদিনটিকে ঘিরে সারাদেশেই নানা কর্মসূচি পালন করা হয়। বাস্তবে কতটা সফল হচ্ছে এসব প্রচেষ্টা। ঠিক এসবের বিপরীত তথ্যই মিলছে গাইবান্ধায়!
বেশি মুনাফার লোভে নিশ্চিত ক্ষতি জেনেও গাইবান্ধায় চাষ করা হচ্ছে তামাক। জেলায় উৎপাদন যোগ্য অন্যান্য ফসলের তুলনায় চাষাবাদে কম খরচ, তামাক ক্রয়কারী কোম্পানিগুলোর প্রলোভন, উৎপাদিত তামাক পণ্য বিক্রয়ের আগাম নিশ্চয়তা এবং বেশি মুনাফার লোভের কারণে জেলায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তামাকের আবাদ।
যদিও কৃষি বিভাগেরর দাবি- তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে অন্যান্য ফসল চাষাবাবাদে প্রণোদনা দেওয়ায় দিন দিন কমছে তামাকের আবাদ। তবে বাস্তবে চিত্র ভিন্ন! কমছে তো নয় বরং জেলায় প্রতি বছরেই বাড়ছে বিষবৃক্ষের এই চাষ।
গাইবান্ধা কৃষি বিভাগ, আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) কোম্পানি এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, গেল বছর (২০২৩) ১০ হেক্টর অর্থাৎ ৭৫ বিঘা জমিতে চামাকের চাষ হলেও এবছর তার তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৯ হেক্টর অর্থাৎ ২শ ১৭ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে তামাকের। এর বেশিরভাগ চাষ হয়েছে- গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ, পলাশবাড়ি ও সাদুল্লাপুর উপজেলায়।
কৃষি বিভাগ এবং কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চাষাবাদে বেশি সুবিধা পাওয়ায় কৃষকরা তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এ কারণে চলমান সরকারি প্রণোদনাও কোনো কাজে আসছে না।
তবে, সচেতন মহল ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, তামাক চাষ কমিয়ে আনতে এর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বেশি প্রচার-প্রচারণা এবং কৃষিখাতে আরো বেশি প্রণোদনা বাড়াতে হবে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণার বরাতে স্বাস্থ্য ও কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তামাক ক্ষেতে কাজ করার সময় একজন তামাক চাষী অজ্ঞাতভাবে দিনে প্রায় ৫০টি সিগারেটের সমপরিমাণ নিকোটিন শোষণ করে থাকেন। এর ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ।
দেশি-বিদেশি তামাক কোম্পানিগুলো চাষীদের স্বল্পমেয়াদে কিছু নগদ লাভের প্রলোভন দেখিয়ে, দীর্ঘমেয়াদে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
এছাড়া, অন্যান্য ফসলের তুলনায় তামাকগাছ মাটি থেকে প্রায় আড়াইগুণ বেশি নাইট্রোজেন, সাতগুণ বেশি ফসফরাস এবং আটগুণ বেশি পটাসিয়াম শোষণ করে। এর ফলে তামাক চাষের জমির মাটি থেকে দ্রুত পুষ্টি নিঃশেষ হয়ে মাটিকে অনুর্বর করে তোলে।
তামাক চাষীরা জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলো তাদের তামাকের বীজ সরবরাহ, তামাকের বীজবপন এবং তামাকপাতা তোলা পর্যন্ত এমনকী সংরক্ষণ প্রক্রিয়া পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে। চাষাবাদে নিয়মিত খোঁজখবর নেন কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া তামাক চাষে তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি পরিশ্রম হলেও কম সময়ে উৎপাদন এবং এর লাভ (মুনাফা) অন্যান্য ফসলের থেকে অন্তত ৮-১০ গুণ বেশি আর তামাক পাতার ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণেই তামাকের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
তারা জানান, অগ্রহায়ণে তামাকগাছ রোপন করে পাঁচ মাসেই এর পাতা তোলা শুরু হয়। প্রতি বিঘা জমিতে তামাক উৎপাদন হয় কমপক্ষে আট বেল (এক বেল সমান পঞ্চাশ কেজি)। এক বেল তামাকের দাম ৬-৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে বিঘাপ্রতি উৎপাদিত তামাকের মূল্য ৫০-৬০ হাজার টাকা, যা উৎপাদনে খরচ হয় মাত্র পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা।
সাদুল্লাপুর উপজেলার ইদিলপুর ইউনিয়নের একবারপুর গ্রামের অনেক পুরাতন তামাক চাষী মুসা মিয়া (৬৫)। গত ছয়-সাত বছর আগে ওই এলাকায় প্রথম তামাক চাষ শুরু করেছেন তিনি।
মুছা মিয়া বলেন, এই এলাকায় আমিই প্রথম তামাক চাষ শুরু করি। তামাকের বীজ কোম্পানি দেয়। বলা যায়, চাষাবাদে বেশিরভাগ খরচই তারা বহন করে। পরে আমরা তামাক পাতা দিয়ে হিসাব করি।
তিনি বলেন, চাষাবাদে যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, এজন্য কোম্পানি থেকে আমাকে চশমা, শরীরে পরিধানের জন্য পোশাক ও হাতের গ্লাভস দেওয়া হয়েছে।
মুসা মিয়া জানান, তার এসব সুবিধা পাওয়া দেখে এখন এলাকার অনেকেই তামাক চাষ করছেন। লাভবানও হচ্ছেন। একবিঘা জমিতে ৫/৬ হাজার টাকা খরচ করে ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ বাদে আয় হয়।
একই ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরে তামাক চাষের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেন ওই এলাকার একাধিক চাষী। তাদের মধ্যে একজন আব্দুল মজিদ মিয়া। ওই এলাকায় গেল মওসুমে তিনি প্রথম তামাকের আবাদ শুরু করেন।
মজিদ মিয়া বলেন, গেল মওসুমে প্রথম আমি দুই বিঘা জমিতে তামাক লাগাই। ধানচাষে খরচ বাদে লাভ কিছুই থাকে না। তামাক চাষে ধানের থেকে কয়েকগুণ লাভ বেশি হয়েছে।
তামাকের ঝুঁকি সম্পর্কে জানেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মজিদ বলেন, ‘আমি জানি, তামাক খেলে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়। মানুষ মারা যায়। আমি নেশা বা বিড়ি-সিগারেট খাই না।কিন্তু এটা চাষ লাভজনক, তাই চাষ শুরু করছি’।
তামাকের ক্ষতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এক গবেষণার রিপোর্টের বরাতে গাইবান্ধা জেলা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মাহবুব হোসেন মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তামাকপণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে, বাজারজাতকরণ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় একটি সিগারেটের শলাকা মোট ১৪ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবেশে নির্গত হয়। এর ফলাফল অত্যন্ত ভয়াবহ! তামাক মূলত হৃৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক হয়ে থাকে। তামাকের ব্যবহারে ফুসফুস প্যানক্রিয়াস, ল্যারিংস ও মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি হয়’।
এ সময় তিনি তামাক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নের প্রতি জোর তাগিদ দেন।
‘পরিবেশ আন্দোলন’ গাইবান্ধার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল হক জনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কোম্পানিগুলো তামাক চাষে চাষীদের অগ্রিম টাকাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে আর এসব প্রলোভনে পড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষীরা। অনেক কৃষকই এর ক্ষতির দিকটা জানেন না।আবার অনেক সচেতন কৃষক জেনেশুনেও অতিরিক্ত লাভের কারণে এটি চাষ করছেন’।
তিনি বলেন, ‘যে সব চাষী তামাকের নিয়মিত চাষ করে থাকেন, তামাকপাতা চাষের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে ধান, পাট, আখ, গম, কলাই, সরিষা ও ভুট্টার মতো ফসল উৎপাদনে তাদের বেশি বেশি প্রণোদনা দিলে এটির চাষাবাদ কমিয়ে আনা যেতে পারে’।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গাইবান্ধার উপ-পরিচালক খোরশেদ আলম সেলফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘তামাক চাষে কৃষকদের কখোনই উদ্বুদ্ধ করা হয় না। তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে ভুট্টা, গম, ধান, পাট, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ ও প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে’।
এ সময় এত সবের পরেও কেন জেলায় তামাকের আবাদ বাড়ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বেশি সুবিধা বিশেষ করে বীজ, কীটনাশক, পরামর্শ ও চাষাবাদের বিভিন্ন উপকরণসহ বিক্রয়ের নিশ্চয়তা পেয়ে কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তবে, আমরা কমিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি’।
ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি) কোম্পানির পলাশবাড়ির (গাইবান্ধা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল হক সেলফোন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অন্যান্য জেলার তুলনায় গাইবান্ধায় তামাকের আবাদ অনেক কম হয়। তবে এখন দিন দিন বাড়ছে’।
তামাক চাষাবাদে চাষীদের কী ধরনের সহায়তা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন, এ প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষকদের লাভবান করতে তাদের স্বল্পমূল্যে বীজসহ নিয়মিত তামাক ক্ষেত পরিদর্শন, তামাক পাতার গুণগত মান ঠিক আছে কি না, সেসব বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখা হয় এবং চাষাবাদে ব্যত্যয় ঘটলে সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হয়।
এছাড়া তামাক চাষাবাদ করতে গিয়ে কৃষকদের যাতে কোনো শারীরিক ক্ষতি না হয়, এজন্য পরিচর্যার জন্য কোম্পানির পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে কৃষকদের পোশাক, হ্যান্ডগ্লোভস ও চোখের চশমা দেওয়া হয়।
কৃষি ফসলেও এমন সুবিধা দিচ্ছে সরকার। কিন্তু তার পরেও তামাক চাষী বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে রহস্য কী, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আসলে চাষীরা এই তামাক পণ্য বিক্রয়ের অগ্রিম নিশ্চয়তা পান। চাষাবাদে সব ধরনের উপকরণ এবং সুবিধা আমরা দিয়ে থাকি। শুধু তাই নয়, কৃষকরা আর্থিকভাবে এবং শারীরিকভাবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন, এজন্য তাদের শতভাগ নিশ্চয়তা (গ্যারান্টি) দেওয়া হয়’।