রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গ্রাফিক্স ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিরুল মোমেনীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ‘ছাত্রীর শ্লীলতাহানি’র মামলার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ করেছেন।
প্রতিবেদনে বাদীর করা এজাহারের অভিযোগের কোন সত্যতা না পাওয়ায় আসামি আমিরুল মোমেনীন চৌধুরীকে মামলা থেকে অব্যাহতি প্রদানের আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা নগরীর চন্দ্রিমা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. রাজু আহমেদ।
প্রতিবেদনে বলা হয়- মামলার বাদীর এজহারনামীয় চারজন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও কেউ এজাহারে বর্ণিত ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান। তারা ওইদিন ঘটনাস্থলে আসামী আমিরুল মোমনীন চৌধুরীকে দেখেননি এবং তাদেরকে না জানিয়ে মামলার সাক্ষী করা হয়েছে উল্লেখ করে রাজশাহী নোটারী পাবলিকের কার্যালয়ে হাজির হয়ে এফিডেভিট করেছেন। ঘটনাস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ভবন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, কর্মকর্তা ও শিক্ষার্থীরা কেউই এ ধরনের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়- এজাহারে বর্ণিত সময়ে আসামী উদয়ন নার্সিং কলেজে ২০১৯ সালের বিএসসি ইন নার্সিং পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ফলে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে মামলার এজাহার দায়ের করায় উক্ত মামলা থেকে আসামিকে অব্যাহতি প্রদানের প্রার্থনা করছি।
জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই রাজু আহমেদ বলেন, ‘বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে একাধিকবার কথা বলেছি। কিন্তু এজাহারে বর্ণিত অভিযোগের ন্যূনতম সত্যতাও পাইনি। এজন্য আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে মামলা থেকে আসামিকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করেছি। প্রতিবেদনের সাথে বিভাগের সভাপতিসহ ১১ জন শিক্ষক, ৭ জন শিক্ষার্থীসহ ২০ জন সাক্ষীর জবানবন্দী যুক্ত করেছি।’
আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফয়সাল নয়ন বলেন, ‘আদালত প্রতিবেদনটি গ্রহণ করে নিয়ম অনুযায়ী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়েছেন। আগামী ১১ অক্টোবর সেখানে শুনানি হবে। তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা হওয়ায় আসামির অব্যাহতি প্রদান এখন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’
মামলার বাদী ওই ছাত্রীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়েছে শুনেছি। তবে ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে মামলার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে পারিনি।’
এদিকে, নিজ বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের নেপথ্যে কয়েকজন শিক্ষকের উস্কানি ছিল বলে অভিযোগ করেছেন খোদ বিভাগের অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ- সামনে ডিন নির্বাচনে প্রার্থিতা এবং ম্যুরাল তৈরির কাজ পাওয়া নিয়ে প্রতিহিংসার জেরে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছেন শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৩ জন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র-উপদেষ্টা অধ্যাপক লায়লা আরজুমান বানুর কাছে অধ্যাপক আমিরুল মোমনীনের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি ও মানসিকভাবে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ করেন। শিক্ষার্থীদের সাথে সেদিন ছাত্র-উপদেষ্টা দফতরে ছিলেন গ্রাফিক্স ডিজাইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বিলকিস বেগম এবং চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের শিক্ষক সুজন সেন। তারাই অভিযোগকারী অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করান বলে জানিয়েছেন খোদ অভিযোগকারী শিক্ষার্থীরাই।
১৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা জানান, ওইদিন তাদেরকে ফোন করে অন্য দু’জন সহপাঠী ক্যাম্পাসের আমতলা চত্বরে আসতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর সহপাঠীদের সাথে শিক্ষকদেরও দেখেন তারা। পরে তাদেরকে ছাত্র-উপদেষ্টা দফতরে যেতে বলা হয়। সেখানে শিক্ষক ড. বিলকিস বেগম ও সুজন সেন সবাইকে অভিযোগপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন। এছাড়া কয়েকজনকে মোবাইল করে অনুমতি নিয়েও নাম জুড়ে দেয়া হয়।
শিক্ষার্থীদের উস্কানি দিয়ে অভিযোগ করানোর বিষয়ে জানতে অধ্যাপক বিলকিস বেগমের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বিভাগের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন। অপর শিক্ষক সুজন সেন শিক্ষার্থীদের উস্কানি বা অভিযোগ দেয়ার সময় ছিলেন না বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘ড. আমিরুল মোমনীন স্যার আমাদের সিনিয়র। উনাকে আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। শিক্ষার্থীরা কী অভিযোগ দিয়েছে, তা সম্পর্কে আমি জানি না।’
অধ্যাপক আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আমি ম্যুরাল নির্মাণের কাজ করেছি। সবশেষ সিএন্ডবি মোড়ে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল বানানোর কাজটিও আমাকে দেয়া হয়। বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকও কাজটি পেতে চেষ্টা করছিল। যখন আমি পেলাম, তখন তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে কাজটি বন্ধ করে দেয়। আর আগামী ডিন নির্বাচনে অনুষদের অনেক শিক্ষক আমাকে প্রার্থী হতে বলছিলেন। বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা ওঠায় কিছু শিক্ষক প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে। এসবের মধ্যেই হঠাৎ শিক্ষার্থীদের উস্কানি দিয়ে একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করিয়েছে।’
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর চন্দ্রিমা থানায় রাবির গ্রাফিক্স ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলা ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আমিরুল মোমেনীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন একই বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এক ছাত্রী।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়- গত ১২ ফেব্রুয়ারি চারুকলার মেইন বিল্ডিংয়ে বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ‘ফ্যাশন এন্ড কস্টিউম ডিজাইন’ পরীক্ষা চলাকালে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মহিলা বাথরুমের সামনে পথরোধ করে ভুক্তভোগী ছাত্রীর শরীরে হাত দেয় এবং পরনের জামা ধরে টানাটানি করেন শিক্ষক আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী।