দেশে মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ রসুন উৎপাদিত হয় নাটোরের গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায়। আংশিক মূল্যে জেলা থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার রসুন বিক্রয় হয় প্রতি মৌসুমে। কিন্ত রসুন উৎপাদনের সম্ভাবনাময় এই জেলায় সারের অতিরিক্ত দাম নিয়ে বিপাকে পড়েছে চাষিরা।
কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সারের ডিলাররা স্বাভাবিকের তুলনায় ১০০ থেকে ৪০০ টাকা করে বেশি দামে বিক্রি করছে টিএসপি, এমওপি এবং ইউরিয়া সার। রসুনসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে অত্যাবশ্যকীয় এই তিন সারের অতিরিক্ত দাম নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিভাগের কোনো মনিটরিং নেই। তবে কৃষকদের স্বার্থে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সারের বাজার তদারকি করলেও দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না।
বিএডিসি ও বিসিআইসি অনুমোদিত নাটোর জেলার প্রতিটি সারের দোকানে সরকার নির্ধারিত মূল্য তালিকা প্রদর্শিত রয়েছে। তালিকা অনুযায়ী ভর্তুকিমূল্যে ইউরিয়া সার প্রতিবস্তা ৮০০ টাকা, টিএসপি সার ১১০০ টাকা, এমপিও ৭৫০ টাকা ও ডিএপি ৮০০ টাকা। কিন্ত দাম নিয়ন্ত্রণে এই তালিকা কোনো কাজে আসছে না বলে অভিযোগ করেছেন চাষিরা। তাদের দাবি, তারা প্রতিবস্তা ইউরিয়া সার ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা, টিএসপি সার ১৫০০ থেকে ১৭০০০ টাকা, এমপিও ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা ও ডিএপি ১১০০ থেকে ১২০০ টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা সারের জন্য কোন ভাউচার দিচ্ছেন না বিক্রেতারা। ভাউচার চাইলে সার বিক্রিতে অপারগতা প্রকাশ করছেন বিক্রেতারা। এছাড়া টিএসপি সার ক্রয়ে শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন অন্যান্য সার ক্রয়ের। চলতি বছর কয়েক ধাপের বন্যায় ফসলহানির ক্ষতি পূরণে এবার চাষিরা আগাম বোরোসহ বিভিন্ন ফসলের বীজতলা তৈরি করছেন। কিন্ত সারের অতিরিক্ত দামে গলদঘর্ম তারা। তাই বাধ্য হয়েই দ্বিগুণ অতিরিক্ত সার কিনছেন তারা।
চলনবিল অধ্যুষিত সিংড়ার বিল তাজপুরের চাষি আরিফুল ইসলাম বলেন, দুই দফা বন্যায় আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে এবার আগাম বীজতলা তৈরির পরিকল্পনা করি। এখন দেখি সারের দাম আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। তাই বাধ্য হয়ে বেশি দামে সার ক্রয় করেছি। কৃষকের স্বার্থ দেখার কেউ তো নেই।
বড়াইগ্রামের মামুদপুর গ্রামের কৃষক আবু রায়হান বলেন, বছরের এই সময়টি রসুন চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। কিন্ত এখনই সার অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে। সারেই যেখানে অতিরিক্ত দাম দিতে হচ্ছে, সেখানে রসুন বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তোলাই কঠিন হয়ে পড়বে।
সারের ডিলাররা অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির কথা স্বীকার না করলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন খুচরা বিক্রেতা জানান, তাদেরও দোকানে সার তুললে বেশি দামেই কিনতে হয়। বেশি দামে কিনলে বেশি দামে কৃষকের নিকট বিক্রি করতে হয়। কিন্ত বেশি দামের অভিযোগ পেলে প্রশাসনের লোকজন তদারকি করে এসে। তাই দাম বেশি সার দোকানেই তোলেন না অনেক খুচরা ব্যবসায়ী।
বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন পারভীন বলেন, আমরা ডিলারদের নিয়ে সভা করে তাদেরকে সরকার নির্ধারিত মূল্যে সার বিক্রির নির্দেশ দিয়েছি। আমরা খোঁজ রাখছি, কেউ বেশি দামে সার বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরর অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মোস্তফা কামাল হোসেন বলেন, সারের কোনোরকম সংকট নেই নাটোরে। কৃষক অভিযোগ দিলে সংশ্লিষ্ট ডিলার বা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জাতীয় কৃষক সমিতি নাটোর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম বলেন, মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের তদারকি না থাকায় সারের ডিলারদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে কৃষকরা। নিজেদের সুবিধার্থে ডিলাররা যে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে তা অনেক শক্তিশালী। প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না কেননা সার বিক্রি বন্ধ করে তারা প্রশাসনকেও জিম্মি করতে পারে।
নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, সম্প্রতি অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তিনি দুই ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেন। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি প্রতি সপ্তাহে সারের বাজার মনিটরিং করছেন।
উত্তরবঙ্গ ফার্টিলাইজার এসোসিয়শনের সহ-সভাপতি ও নাটোর বিএফএ'র সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, সারের কৃত্রিম নয়, প্রকৃতই সংকট রয়েছে এবং তা কৃষকের বর্ষিত চাহিদার প্রেক্ষিতে। কৃষকের সারের চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। কিন্ত সে তুলনায় সারের বরাদ্দ কম। আমার নিজেরই বরাদ্দ ছিলো ৪টন বা ৮০ বস্তা। কিন্ত একজন কৃষকেরই প্রয়োজন ৫ থেকে ১০ বস্তা করে। সরকার অনুমোদিত ডিলারদের অন্য কোনো উপায়ে সার সংগ্রহ করে বিক্রির কোন সুযোগ নেই। সরকারের প্রতি আমাদেরও দাবি যেন ডিলার প্রতি বরাদ্দ করা হয়।
জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ বলেন, অতিরিক্ত দামে সার বিক্রির অভিযোগ আমাদের কাছেও এসেছে। আমরা কৃষদের এসব অভিযোগ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছি এবং প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সারের বাজার মনিটরিংয়ের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।