রংপুর বিভাগের গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপন প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত হিসাবে গৃহীত হবে। অর্ধ-শতাব্দীর বেশী সময় ধরে সমগ্র গাইবান্ধায় বৃহৎ শিল্প কারখানা বলতে শুধুমাত্র রংপুর সুগার মিলস লিমিটেড ছিল। বছরের পর বছর লোকসানের বোঝা টানতে টানতে রংপুর চিনি কল বন্ধ হয়ে গেছে। রংপুর সুপার মিলের মোট লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। যেখানে বাজারে প্রতি কেজি চিনির খুচরা মূল্য ৬০ টাকা, সেখানে তাদের প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ২০০ টাকা! এত বিশাল অংকের টাকা ভর্তুকি দিয়ে সরকারের পক্ষে কখনো রংপুর চিনি কল চালু রাখা সম্ভব নয়।
রংপুর চিনি কলের অধীনে বাগদা ফার্মে মোট ১৮৪০ একর জমি রয়েছে। রংপুর চিনি কল ও আখ চাষ বন্ধ রেখে চিনিকল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও বাংলাদেশ চিনি শিল্প করপোরেশনের পক্ষে এই বিশাল পরিমান জমির রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। ২০১৬ সালে ৬ নভেম্বর সাঁওতালদের সাথে চিনি কল কর্তৃপক্ষের সংঘর্ষের সূত্রপাত আখ মাড়াই কেন্দ্র করে। সাঁওতাল ট্র্যাজেডির পরর্বতী ২ বছর বাগদা ফার্মে আখ চাষ করলেও বর্তমানে আর আখ চাষ হয় না। ২০২০ সাল থেকে আদিবাসী সাঁওতাল ও স্থানীয় বাঙ্গালীরা মিলে অবৈধভাবে জমিতে চাষবাস করছে।
আজ যখন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপন করার একটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, ঠিক তখন কতিপয় সাঁওতাল ও বাঙ্গালী মিলে এর তীব্র বিরোধীতা করছে। সাঁওতালদের সংগ্রাম ইতিহাস অনেক পুরোনো ও গর্বের। কিন্তু আজ তারা যা করছে, তা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশ কৃষিখাতের পাশাপাশি শিল্পখাতেও এগিয়ে যাবে। কৃষিকাজ আমাদের অতীত ও বর্তমান হলেও শিল্পক্ষেত্রেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিহিত। তাহলে কৃষিক্ষেত্রের পাশাপাশি শিল্পক্ষেত্রেও দেশ বিকশিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিপূর্ণ সোনার বাংলায় পরিনত হবে।
কিছুদিন আগে সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার ও সংগ্রাম কমিটি পুনরায় গঠন করা হয়েছে। আগের কমিটিতে সভাপতি ফিলিমন বাস্কে ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল মাস্টার স্বপন ছিল, বর্তমান কমিটিতে সভাপতি বার্নাবাস টুডু ও সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম প্রধান নির্বাচিত হয়েছে। নব-নির্বাচিত সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার ও সংগ্রাম কমিটির সাম্প্রতিক কর্মকান্ড গোবিন্দগঞ্জে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) এর বাস্তবায়ন নৎসাত করার পরিকল্পনা বলে মনে হচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি দ্বারা সেটাই পরিলক্ষিত হয়। অথচ গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড স্থাপনের জন্য বাগদা ফার্মের সর্বনিম্ন ২৫০ একর থেকে সর্বোচ্চ ৪৫০ একর জমি প্রয়োজন। তারপরেও বাগদা ফার্মে বিশাল পরিমান জমি অবশিষ্ট থাকবে। তবু তারা বাগদা ফার্মে ইপিজেড স্থাপনের তীব্র বিরোধিতা করছে। গোবিন্দগঞ্জে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপিত হলে তারাই প্রকৃতপক্ষে উপকৃত হবে। তাদের এই বিরোধিতা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
গোবিন্দগঞ্জে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় একটি সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। গাইবান্ধা জেলার মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৫ লক্ষ, আর গোবিন্দগঞ্জের মোট জনসংখ্যা ৫ লক্ষেরও বেশি। এই বিশাল মানবসম্পদের সম্পূর্ণ ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। একমাত্র গোবিন্দগঞ্জে একটি শিল্প অঞ্চল স্থাপনের মাধ্যমে এই মানবসম্পদকে যথাযোগ্য কাজে লাগানো সম্ভব। গোবিন্দগঞ্জে একটি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপিত হলে সমগ্র গাইবান্ধা জেলার পাশাপাশি পাশ্ববর্তী বগুড়া ও দিনাজপুর জেলার মানুষ এখানে এসে কাজ করতে পারবে। সাপমারা ইউনিয়নের অনুন্নত বাগদা ফার্ম অঞ্চলটি একটি আধুনিক নগরীতে রুপান্তরিত হবে।
বাংলাদেশের কোথাও নতুন করে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপন করা হলে সেটা গোবিন্দগঞ্জে হওয়া অত্যাবশকীয়। কারণ আমাদের দেশে ফসলি জমি নষ্ট করে শিল্পকারখানা স্থাপন করা যায় না। এটা সম্পূর্ণ আইন পরিপন্থী কাজ। একদিকে দেশে এত পরিমানে অনাবাদি জমি পাওয়া দুষ্কর। অপরদিকে পরিবেশের ক্ষতি করে বন কিংবা জলাশয় ভরাট করে শিল্প অঞ্চল স্থাপন করা কখনো সম্ভব নয়। এখানে ইপিজেড স্থাপিত হলে শিল্পকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য পাশ্ববর্তী শুকনো কাটাখালি নদী রয়েছে। তাতে করে নদীর পানি প্রবাহ কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। গোবিন্দগঞ্জে বাগদা ফার্মের পরিত্যক্ত জমিতে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপন করলে সরকারের বিশাল অংকের টাকা সাশ্রয় হবে। সেই সাথে রংপুর চিনি কল সংশ্লিষ্ট শ্রমিক ও তাদের পরিবারের লোকজন এই ইপিজেডে কাজের মাধ্যমে পুর্নবাসনের সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে চট্রগ্রামের হালিশহরে প্রথম ইপিজেড স্থাপিত হয় এবং ২০০৬ সালে চট্রগ্রামের পতেঙ্গায় সর্বশেষ কর্ণফুলী ইপিজেড স্থপিত হয়। বাংলাদেশে সরকারিভাবে ৮টি ও বেসরকারিভাবে ২টি ইপিজেড রয়েছে। গোবিন্দগঞ্জে রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা (ইপিজেড) স্থাপিত হলে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেই সাথে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও বেকারত্ব দূর হবে। বিদেশে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে ও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে সক্ষম হবে। বেকারত্বের হার কমে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। ফলে মাথাপিছু আয়ও বাড়বে।
এমন সুযোগ সবসময় আসে না, এই সুযোগ এসেছিল ঠিক ৬৭ বছর আগে ১৯৫৪ সালে রংপুর চিনি কল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এখন যদি কোন কারণে গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড স্থাপনের পরিকল্পনা বাতিল হয়, তবে আগামী ৫০ বছরেও আর এমন সুযোগ আর আসবে না। আশাকরি বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা) সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে গোবিন্দগঞ্জে ইপিজেড স্থাপনের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিবেন। বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম (এসপিপি, এনডিইউ, এএফডাব্লিউসি, পিএসসি, জি) বাগদা ফার্মে পরিদর্শন শেষে ইপিজেড বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। তাহলে গোবিন্দগঞ্জ বাংলাদেশের বুকে একটি শিল্পাঞ্চল, সমৃদ্ধশালী ও উন্নয়নশীল উপজেলা হিসাবে পরিচিতি লাভ করবে।