আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বরাদ্দ টেকসই জ্বালানি এবং জ্বালানি রূপান্তরের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করে অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমানো, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসা, বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জ ব্যয় কমানো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রণোদনা বাড়ানো সংক্রান্ত সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের নির্দেশনাও নেই প্রস্তাবিত বাজেটে বলে দাবি করেছেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
জ্বালানি খাতের রূপান্তর ও টেকসই জ্বালানি খাত নিশ্চিত করতে গ্যাস ও বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে যৌক্তিক প্রাধিকার পুনঃনির্ধারণ করে বাজেটের বরাদ্দে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রোববার (২৩ জুন) সিপিডির পক্ষ থেকে আয়োজন করা ‘জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ এ বিদ্যুৎ ও শক্তি সেক্টর: চ্যালেঞ্জ এবং প্রস্তাবিত ব্যবস্থা’ শীর্ষক এক ডায়ালগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এ সব কথা বলেন গোলাম মোয়াজ্জেম।
অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সংসদ সদস্য একে আজাদ, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ হোসাইন, বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম, বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের রেক্টর মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমামসহ অনেকেই বক্তব্য রাখেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে চলমান ম্যাক্রো ইকোনমিক চ্যালেঞ্জের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এই খাতের চ্যাালেঞ্জগুলো পুরো অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে হুমকিতে ফেলেছে।
তিনি বলেন, লোডশেডিং কমানো, বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা, এ খাতে ভর্তুকি কমানো ও জ্বালানির জন্য আমদানি নির্ভরতা কমাতে অভ্যন্তরীণ গ্যাস আহরণের বিকল্প না থাকলেও জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উন্নয়ন ব্যয় প্রস্তাবিত বাজেটে কমানো হয়েছে। এই বরাদ্দ দিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬ গ্যাস কূপ অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্ভব হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগটিকে অযোৗক্তিক আখ্যা দিয়েছেন গোলাম মেয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে হবে। তবে সেটা দাম বাড়িযে নয়, বরং উৎপাদনে দক্ষতা নিশ্চিতের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জ কমাতে নো ইলেক্ট্রিসিটি নো পে সিস্টেমে যেতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বাতিল না করা, বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কেনা ও দেনা পরিশোধে চড়া সুদে ঋণ নেওয়া অব্যাহত থাকলে এ খাতে ভর্তুকি কমবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
আমাদের ইমার্জেন্সি পাওয়ার সাপ্লাই অ্যাক্ট রয়েছে। এর কারণে প্রতিযোগিতামূলক বিডিং না হওয়ায় বাজারমূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুতে না বরং নবায়নযোগ্য শক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও এমনটা হচ্ছে, মন্তব্য করে তিনি বলেন, বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার কারণে দাম বাড়িয়েও এ খাতে ভর্তুকি কমছে না।
আগামীতে নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে আর বিনিয়োগে দর সুযোগ নেই দাবি করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পিক আওয়ারে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। ১৪ হাজার ২৬১ মেগাওয়াটের এই বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতার বড় অংশ ২০৩০ সালেও অব্যহার্য থাকবে।
বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যেও সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা আর জ্বালানি সংকটের কারণে চাহিদার চেয়ে উৎপাদনে প্রতিদিন হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত ঘাটতি থাকছে। এর ফলে ময়মনসিংহ, খুলনা ও কুমিল্লা বিভাগে প্রায়শই লোডশেডিং হচ্ছে।
এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েছে সিপিডি।
এ বিষয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বরাবরের মতই অবহেলার প্রবণতা রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত বৈষম্যমূলক রাজস্ব কাঠামোর মোকাবিলা করছে দাবি করে তিনি বলেন, এ খাতে বিনিয়োগকারীদের অন্তত জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমান সুযোগ দিতে হবে, এবং তা পর্যায়ক্রমে বাড়াতে হবে।
বাজেটে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ট্যাক্স হলিডে পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছরে উন্নীত করা, ছোট আকারের সৌরভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে শতভাগ শুল্ক মওকুফ এবং সৌর বিদ্যুৎ-সম্পর্কিত উপকরণে ক্রমবর্ধমান করের হার কমানোর সুপারিশ করেন তিনি।