কমার্স কলেজের শিক্ষার্থী হত্যা

মাসব্যাপী প্রস্তুতি নিয়ে সহপাঠীকে হত্যা করেন রাজিন

  • আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

একমাসের প্রস্তুতি নিয়ে সহপাঠীকে হত্যা করেন রাজিন/ছবি: বার্তা২৪.কম

একমাসের প্রস্তুতি নিয়ে সহপাঠীকে হত্যা করেন রাজিন/ছবি: বার্তা২৪.কম

রাজধানীর মিরপুরে সহপাঠীর বাসায় হত্যার শিকার হয়েছিলেন ঢাকা কমার্স কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জুবায়ের হাসান রাফিত (১৮)। ধারালো বটি দিয়ে চৌধুরী রাজিন ইকবাল নামের অপর এক সহপাঠী নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তাকে। মিরপুরের শাহআলী থানার রাইনখোলা এলাকায় সরকারি কোয়ার্টারে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

এই ঘটনায় নিহতের বাবা আবুল বাশার বাদী হয়ে রাজিন ও তার বাবা ইকবাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় রাফিতের বাবা পূর্ব বিরোধের ঘটনায় এই হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছেন। বাবার অভিযোগের সূত্র ধরে বার্তা২৪.কমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ঘাতক রাজিনের ঠান্ডা মাথায় সহপাঠীকে হত্যার নানা তথ্য।

বিজ্ঞাপন

রাজিনের সহপাঠী ও একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা কমার্স কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের তিস্তা-২ সেকশনের শিক্ষার্থী ছিলেন রাজিন ও নিহত রাফিত। সেকশনের ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলেন রাফিত। তারা দুজনেই সহপাঠী এক তরুণীকে পছন্দ করতেন। তবে ওই তরুণী রাজিনকে এড়িয়ে চলায় বিষয়টি নিয়ে রাফিতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান। তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি শিক্ষার্থী উপদেষ্টাদের কাছে যায়। পরবর্তীতে তারা সমাধান করতে না পারায় কলেজ অধ্যক্ষ আবু মাসুদের মধ্যস্থতায় মিমাংসা করা হয়।

কলেজের প্রধানের কাছে অভিযোগ যাওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন রাজিন। প্রথমে রাফিতকে এড়িয়ে চললেও গত এক মাস ধরে নানাভাবে তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি।

সর্বশেষ গতকাল শনিবার বিকেলে কোচিং শেষে রাফিতকে নিজ বাসায় ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেন রাজিন। সুরতহাল প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, রাফিতের গাল, বুক, কপাল, চোখে অসংখ্য কোপের চিহ্ন রয়েছে।

রাফিত ও রাজিনের দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিস্তা-২ সেকশনের শিক্ষার্থী উপদেষ্টা সাইদুল হাসান সুমন বলেন, এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। রাফিত ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিল। সে তো এমন কোনো বিষয় আমাকে জানায়নি। আসলে আমি ৮টি সেকশনের ইনচার্জ। কলেজের বাইরে কিছু হয়েছে কি-না আমার জানা নেই।

দুই শিক্ষার্থীর দ্বন্দ্ব মিমাংসা করে দিলেও রাফিত হত্যার পরে সব অস্বীকার করছেন ঢাকা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ আবু মাসুদ।

তিনি বলেন, এ ধরনের দ্বন্দ্ব নিয়ে আমার কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। আমার এই বিষয়টি জানা নেই। রাফিতের বাবা-মা'কে কলেজে ডাকার বিষয়েও আমার জানা নেই।

অধ্যক্ষ মাসুদ আরও বলেন, আমাদের কলেজের শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হলে শৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে সমাধান করা হয়। সুতরাং আমার কাছে অভিযোগ আসার তথ্য সঠিক নয়।

রোববার (০৭ জুলাই) বিকেলে মিরপুরের শাহ আলী থানার রাইনখোলা এলাকার কমার্স কলেজ লাগোয়া সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের (লাল বিল্ডি) রাজিনের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনের সামনে প্রতিবেশীসহ আশেপাশের অনেকেই দাঁড়িয়ে সহপাঠীর হাতে রাফিতের হত্যার বিষয়টি নিয়ে আলাপ করছেন। লাল রঙের চার তলা ভবন অনেকটা নিরিবিলি। তৃতীয় তলায় সিঁড়ির ডান পাশেই রাজিনদের ফ্ল্যাট।

বাসার সামনে গিয়ে দেখা যায়, ফ্ল্যাটের কাঠের দরজার আগে একটি লোহার গেট। দুই গেটের মাঝে তিন ধাপের সিঁড়ি। হত্যার পরেই এই সিঁড়িতেই পড়ে ছিল রাফিতের নিথর দেহ। ফলে সিঁড়ির পুরোটাই রক্তাক্তে রঞ্জিত। রক্ত গড়িয়েছে ফ্ল্যাটের বারান্দাতেও। তবে এখন রক্ত অনেকটা শুকিয়ে গেছে।

জানালা দিয়ে রুমের ভেতরে দেখা গেছে, ভেতরে লাইট জ্বলছে। ফ্যান ঘুরছে। বিছানার তোশক এলোমেলো। ফ্ল্যাটের কাঠের দরজাটি খোলা, তবে চাপানো অবস্থায় রয়েছে। তালাবদ্ধ রয়েছে বাইরের লোহার গেটটি।

ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ও কমার্স কলেলের অফিস সহকারী সবুজের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃতীয় তলার তিন রুমের ফ্ল্যাটে রাজিন ও তার বাবা বসবাস করতেন। তার মা ঢাকার বাহিরে থাকেন। এক বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে যেতেন। রাজিন আশেপাশের কারো সঙ্গেই মিশতো না। কলেজ বা কোচিং থেকে ফিরে বাসার দরজা বন্ধ করে রাখতেন। বাবা-ছেলের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারেননি তিনি।

ভবনের বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার (০৬ জুলাই) বিকেলে হত্যার পরে সহপাঠী রাফিতের মরদেহ রুমের সামনের ছোট সিঁড়িতে ফেলে রেখে ঘরে অবস্থান করছিল রাজিন। প্রতিবেশীসহ ভবনের বাসিন্দারা রক্তাক্ত অবস্থায় রাফিতকে পড়ে থাকতে দেখেন। তারা প্রথমে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ -এর মাধ্যমে শাহআলী থানা পুলিশ জানায়। পুলিশ আসার আগে প্রতিবেশীরা রাজিনের বাবা ইকবালকেও ফোন করে ঘরের সামনে রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকার বিষয়টি জানান। এই খবর পেয়ে তিনি বাসায় এসে ছেলেকে ডাকাডাকি করেন। সাড়া-শব্দ না পেয়ে লোহারগেট খুলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করেন। কিছু সময় পর তিনিও বাসা থেকে বের হয়ে যান। ইকবাল বের হওয়ার কয়েক মিনিট পরে ঘাতক রাজিনও হেঁটে বেরিয়ে যান। এরপর থেকে বাবা ও ছেলে আত্মগোপনে রয়েছেন।

রাজিনের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইকবাল আহম্মেদ চৌধুরী ও রাশিদা চৌধুরী বড় ছেলে চৌধুরী রাজিন ইকবাল। বাবা পেশায় আইনজীবী, মা কলেজ শিক্ষক। পেশাগত কারণে তিনি ঝিনাইদহে থাকেন। বাবা ও ছেলে কমার্স কলেজ লাগোয়া সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন। রাজিন ঝিনাইদহে মার্শাল আর্টে পারদর্শী হন। অত্যন্ত চুপচাপ রাজিনের তেমন কোনো বন্ধু ছিলো না। ক্লাসেও চুপচাপ থাকতো। বাবা-মায়ের কড়া শাসনের মধ্যে থাকতেন। তার বাবা চাইতেন না রাজিন কারো সঙ্গে মিশুক। ফলে মা না থাকায় বেশিরভাগ সময় একাই বাসায় থাকতেন রাজিন।

রাজিনের একাধিক সহপাঠী বার্তা২৪.কম-কে জানিয়েছে, রাজিন দেখতে ভদ্র ও শান্ত হলেও ভেতরে ভেতরে তার হিংস্র মানষিকতা ছিল। সহপাঠীদের কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতো না। সুযোগ পেলেই নিজের মোবাইলে দাবা খেলতো। প্রায় সময় সহপাঠীদের বলতো, ‘আমি কি জিনিস তোরা আমাকে চিনিস না। আমার আন্ডারওয়াল্ডে যোগাযোগ আছে। তোরা আমাকে পাবি না।’

রাফিতকে হত্যার আগে গত একমাস সব সময় রাজিনের সঙ্গে আড্ডা ও গল্প করতেন। সবসময় তার ঘনিষ্ঠ ও কাছাকাছি থাকার চেষ্টা ছিল রাজিনের। কলেজের বাইরেও তারা আড্ডা দিতেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বিকেলে কোচিং শেষে রাফিতকে নিজ বাসায় ডেকে নিয়ে হত্যা করে রাজিন।

রাফিতের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রুপগঞ্জ সদর এলাকায়। তিন ভাই বোনের মধ্যে রাফিত বড়। এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে জিপিএ-৫ পাওয়া রাফিত মিরপুর ১০ নম্বরে মামা নুরুজ্জামানের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতেন।

ঘাতক রাজিনের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার সুলতানপুর এলাকায়। মায়ের কর্মসূত্রে ঝিনাইদহ থেকে এসএসসি পাশ করে কমার্স কলেজে ভর্তি হন। এরপর বাবার সঙ্গে থাকতেন রাজিন।

মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে শাহআলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারিকুজ্জামান বলেন, কমার্স কলেজের শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। নিহতের বাবা আবুল বাশার বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। আমরা আসামিদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি।