মতিউরের স্বজনদের সম্পদের পাহাড়, দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়ে হতবাক গ্রামবাসী!

, জাতীয়

এস এল টি তুহিন,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,বার্তা২৪.কম,বরিশাল | 2024-06-27 00:51:46

বর্তমান সময়ে দেশের আলোচিত ঘটনা 'ছাগল কাণ্ড' ঘটনার মূল চরিত্রে আসীন হওয়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের জন্ম বরিশালের মুলাদী উপজেলায় বাহাদুরপুর গ্রামে। নিজ গ্রামের মানুষ তাকে চেনেন পিন্টু নামে।

পার্শ্ববর্তী বাবুগঞ্জ উপজেলায় খালা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করা মতিউর রহমান পিন্টুর সম্পদের পাহাড় এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর বিষয়টি নিয়ে পুরো গ্রামজুড়েই চলছে সমালোচনার ঝড়। একজন স্কুল শিক্ষকের সন্তান হয়ে কীভাবে গড়েছেন এতো সম্পদের পাহাড় সেই প্রশ্নে হতবাক গ্রামবাসী।

নিজ গ্রাম মুলাদীতে তেমন সম্পদ নেই মতিউর রহমান পিন্টুর নামে। তবে স্বজনদের রয়েছে বাড়ি, গাড়িসহ অঢেল সম্পদের পাহাড়। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে মতিউর রহমান পিন্টুর হাত ধরে। স্থানীয়দের দাবি, মতিউর রহমান রাজস্ব কর্মকর্তা হওয়ার পরপরই অর্থ-সম্পদে ফুলে ফেঁপে ওঠেন পরিবারের অন্য সদস্যরা।

বুধবার (২৬ জুন) সরেজমিনে মুলাদীর কাজিরচর ইউনিয়নের বাহাদুরপর গ্রামে দেখা যায়, মতিউর রহমানের গ্রামের বাড়িতে দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল আলিশান বাড়িসহ রয়েছে দৃষ্টিনন্দন নানান স্থাপনা। খালের ওপর নির্মিত পাকা সেতু পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে দৃষ্টিনন্দন মাদ্রাসা ও মসজিদ। একপাশে তিনতলা মাদ্রাসা এবং অপরপাশে দ্বিতল মসজিদ। দুটি স্থাপনার মাঝেই রয়েছে বিশাল দৃষ্টিনন্দন গেট। সেই গেট পার হয়ে যেতে হয় মতিউর রহমান পিন্টুর বাড়িতে। তবে বুধবার বিকেলে সেই বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি কাউকে। বাড়ির কলাপসিবল গেটে ঝুলছে তালা। ভেতরে লোক থাকলেও সাংবাদিক দেখেই লুকিয়ে পড়েন তারা।

মতিউর রহমান পিন্টুর বাড়ির দক্ষিণ দিকে রয়েছে রহমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ। তার পাশেই তিনতলা একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। যা ব্যবহার করা হচ্ছে কলেজ ভবন হিসেবে। এদিকে, পিন্টুর বাড়ির সামনে দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া খালের দুই পাড় বাঁধানো হয়েছে সিমেন্টের ব্লক দিয়ে। খালের দুই পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে পৃথক দুটি পাকা রাস্তা। খালের দুই পাড়ের প্রতিটি বাড়ির সামনে বাঁধানো হয়েছে অসংখ্য ভানায় খাটলা। খালের ওপর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি সেতু।

স্থানীয়দের দাবি, নিজের এবং স্বজনদের বাড়িঘর রক্ষায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় শত কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান পিন্টুর প্রচেষ্টায়।

মতিউর রহমান পিন্টুর মেঝ ভাই কাইয়ুম শের হাওলাদার। যিনি একসময় শিক্ষকতা করলেও বর্তমানে ঢাকার বড় শিল্পপতি। মুলাদী পৌর এলাকায় থানার পাশেই রয়েছে তার দোতলা বাড়ি। গ্রামে আসলে ওই বাড়িতেই থাকেন কাইয়ুম হাওলাদার।

বরিশাল মুলাদীর প্যাদারহাট বাজারে পিন্টুর ছোটভাই নুরুল হুদার রয়েছে বহুতল ভবন। সেই ভবনেই পিন্টুর মায়ের নামে চালু করা হয়েছিল একটি ক্লিনিক। স্থানীয়দের দাবি, ক্লিনিকটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এর বাইরে গ্রামে অনেক জমিও রয়েছে পরিবারের সদস্যদের। এসব সম্পত্তি মতিউরের পরিবার করলেও এর প্রকৃতি মালিক কে তা জানা নেই কারোর।

স্থানীয়দের দাবি, সকল প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলা হয়েছে পাওলাদার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। এমনকি সেই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই পরিচালনা হচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে এ ফাউন্ডেশনে কারা জড়িত এবং অর্থের উৎস কী জানা নেই গ্রামবাসীর।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. আব্দুস ছত্তার বার্তা২৪.কমকে বলেন, 'মতিউর রহমান নামেই পরিচিত এনবিআরের সাবেক সদস্য পিন্টুর বাবা হাকিম হাওলাদার একসময় ঢাকার টঙ্গীতে একটি কারখানায় চাকরি করতেন। সেখান থেকে এসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। অবসরে গিয়ে কাজিরচর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন তিনি।

এরপর দায়িত্ব পালন করেন টানা ৯ বছর। গ্রামে যে বাড়িটি নির্মাণ করেছে সেটা হাকিম হাওলাদারের নির্মাণ করা, দাবি আব্দুস ছত্তারের। তবে মতিউর ও তার পরিবার কীভাবে এতো অর্থ সম্পদের মালিক হলেন তা জানা নেই স্থানীয় বাসিন্দাদের।

জানা গেছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০০৩ সালে কাজিরচর ইউপি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন মতিউরের বাবা হাকিম হাওলাদার। জীবদ্দশায় তিনি কাজিরচর ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি ছিলেন। মুলাদী উপজেলা ১৪ দলের বর্তমান সমন্বয়ক ইউসুফ আলীকে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আবার ওয়ান-ইলেভেনের সময় চেয়ারম্যান পদের মেয়াদ শেষ হলেও নানা উপায়ে আরও প্রায় চার বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকেন হাকিম।

অপরদিকে, স্কুলজীবন থেকেই মেধাবী ছিলেন মতিউর। তবে পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে মুলাদীর পার্শ্ববর্তী বাবুগঞ্জ উপজেলায় খালার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন তিনি। পরিবারে ৩ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে বড় মতিউর রহমান পিন্টু বিএনপি শাসনামলে বিএনপি নেতা মোশারেফ হোসেন মঙ্গুর পরিবারের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন।

রাজস্ব ক্যাডারে যাওয়ার আগে ১১তম বিসিএসে ট্রেড ক্যাডারে চাকরি হয়েছিল তার। ট্রেড ক্যাডার বিলুপ্ত হলে পছন্দ অনুযায়ী অন্যান্য ক্যাডারে যাওয়ার সুযোগ পান ট্রেড ক্যাডারের কর্মকর্তারা। আর রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে মতিউরের যোগদানের পর এই পরিবারকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, মতিউর রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত হাকিম হাওলাদারের পরিবারে তেমন সচ্ছলতা ছিল না। গ্রামে জায়গা-জমির পরিমাণও খুব বেশি ছিল না। তবে ৯১-পরবর্তী বিএনপির শাসনামলে রাজস্ব কর্মকর্তা হিসাবে মতিউরের উত্থানের পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে এই পরিবারের অর্থবিত্তের চিত্র।

তারা আরও জানান, মতিউর রহমানের মেজভাই কাইয়ুম হাওলাদারের শুরু শিক্ষকতা দিয়ে। ভাই রাজস্ব কর্মকর্তা হওয়ার পর সম্পদের পাহার গড়ার মিশনে নামেন তিনি। রাজধানী ঢাকার টঙ্গীতে গড়ে তোলেন ট্রাভেল ব্যাগ তৈরির কারখানা। ছাগল কাণ্ডের আগে অর্থাৎ ঈদের একমাস আগেও সোনালী ব্যাংক থেকে বড়ভাই মতিউর রহমানের প্রভাবে তিনশত কোটি টাকার লোন নেন কাইয়ুম হাওলাদার। বাবা বিএনপি নেতা হলেও সম্প্রতি মুলাদীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নিজের নাম লেখান কাইয়ুম। অর্থবিত্তের প্রভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন আধিপত্য। বাবাকে চেয়ারম্যান বানাতে প্রচুর টাকা খরচ করেছিলেন মতিউর। কারণ ২০০৩ সালে মতিউর ছাড়া তখন অন্য ভাইয়েরা স্বাবলম্বী ছিলেন না।

এদিকে, মতিউর ঢাকার বিত্তশালী হওয়ার বিষয়টি জানলেও তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানা ছিল না এলাকাবাসীর। মতিউরের গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী মাসুম বার্তা২৪.কমকে বলেন, মতিউর রহমানের পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। গ্রামের বাড়িতে তাদের খুব একটা যাতায়াত নেই। গ্রামের বাড়িটি দেখাশোনার জন্য একজন কেয়ারটেকার রয়েছে। তার বাড়িও খুলনায়।

তিনি জানান, ২০১৮ সালে মতিউর রহমানের বাবা আবদুল হাকিম হাওলাদার মৃত্যুবরণ করেন। তখন মতিউর রহমান বাড়িতে এসেছিলেন। পরের বছর মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়িতে আসেন। বাড়িতে তার ছোট ভাই নুরুল হুদা ও মেজ ভাই কাইয়ুম হাওলাদার মাঝেমধ্যে আসেন। তিনি জানান, নুরুল হুদা ঈদের এক দিন আগে এসে কোরবানি দিয়েছেন। পরে আবার ঢাকায় ফিরে গেছেন।

বাহাদুরপুর রহমানিয়া টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ মো. খলিলুর রহমান বার্তা ২৪.কমকে বলেন, 'এ প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মতিউর রহমান। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হয়েছে। এখানের বর্তমান সভাপতি মতিউর রহমান। তবে আমি যোগদান করেছি প্রায় ৮ মাস। এর মধ্যে একবারের জন্যও গ্রামে আসেননি তিনি। বিদ্যালয় পরিচালনার বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হলে তার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। বর্তমান ঘটনার পর থেকে তার সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বাহাদুরপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিএম কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় খাল ভরাট করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় কৃষক এবং জনপ্রতিনিধিরা বিরোধিতা করলেও সুফল পাননি তারা। মতিউর রহমানের প্রভাবের কাছে হার মানতে হয় তাদের।

এ প্রসঙ্গে মুলাদীর কাজিরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মন্টু বিশ্বাস বার্তা২৪.কমকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি গড়ার সময় এলাকার কৃষকেরা প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। জোয়ার-ভাটার খাল আটকে দেওয়ায় শুকনো মৌসুমে ফসলি জমিতে সেচ দিতে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের।

এ সম্পর্কিত আরও খবর