মেডিকেল ভিসায় শর্তের জালে ভারতে আটকা শতাধিক পাসপোর্টধারী

, জাতীয়

আজিজুল হক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বেনাপোল (যশোর) | 2024-07-03 13:41:26

মেডিকেল ভিসা নিয়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভারতীয় দূতাবাসের নতুন শর্তের জালে পড়ে কয়েক'শ পাসপোর্টধারী ভারতে আটকা পড়েছেন। দেশে ফিরতে ভারতীয় ইমিগ্রেশন ব্যুরো অফিসে আবেদন করলেও কাজের ধীরগতিতে দুই সপ্তাহ ধরে আটকে থেকে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। ভুক্তভোগীরা চিকিৎসা সেবার জটিলতা কমিয়ে ভারত ভ্রমণ সহজীকরণের আহ্বান জানিয়েছেন। 

হঠাৎ এমন শর্তের ফাঁদে পড়ে ভারতে ১৩ দিন ধরে আটকে থাকা ভুক্তভোগী মেডিকেল ভিসার পাসপোর্টধারী সাইদুর নীর সালিন জানান, তার বাবা মোহাম্মদ শাহ আলম জটিল রোগে আক্রান্ত । স্বজনদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য ধার করে মেডিকেল ভিসায় গত মাসে বাবাকে নিয়ে তিনি ভারতে এসেছিলেন। আসার আগে তিনি ভারতীয় দূতাবাসের শর্ত অনুযায়ী কলকাতার একটি হাসপাতালে প্রত্যায়নপত্র নেন। কিন্তু ভারতে এসে জানতে পারেন হায়দ্রাবাদে আরও উন্নত চিকিৎসা মিলবে। পরে তিনি কলকাতায় না দেখিয়ে হায়দ্রাবাদে চিকিৎসা করান। এসময় চিকিৎসক তার বাবাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অপারেশনের পরামর্শ দেন। কিন্তু বাবার শারীরিক অবস্থার খুব অবনতি এবং চিকিৎসার জন্য বড় অংকের অর্থ প্রয়োজন হওয়ায় তাদের ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। গত ২১ জুন ফেরার সময় ভারতের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন চিকিৎসার কাগজপত্র দেখে অভিযোগ করেন কলকাতায় না দেখিয়ে কেন হায়দ্রাবাদে ডাক্তার দেখিয়েছেন। এক পর্যায়ে তাদের দুইজনের পাসপোর্ট আপলোড সিল মেরে দেশে ফেরতের উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেয় এবং দেশে ফিরে ভুল স্বীকার করে অনলাইনে ইমিগ্রেশন ব্যুরোতে আবেদন করতে বলেন। বাধ্য হয়ে তারা ফিরে গিয়ে বঁনগার একটি আবাসিক হোটেলে ওঠেন এবং অনলাইনে ইমিগ্রেশন ব্যুরো বরাবর ঐ দিনই আবেদন করেন । কিন্তু আবেদনের দুই সপ্তাহ পার হলেও ইমিগ্রেশন থেকে উত্তর না আসায় তাদের হোটেলে আটকে থাকতে হচ্ছে। একদিকে অর্থকষ্ট অন্যদিকে অসুস্থ শরীর নিয়ে তার বাবাকে সময় কাটাতে হচ্ছে। কবে ফিরতে পারবেন নিজেও জানেন না। তাদের মত আরও অনেক মেডিকেল ভিসায় চিকিৎসার জন্য পাসপোর্টধারী এ সমস্যায় আটকা পড়েছেন বলে জানান তিনি। 

এদিকে উন্নত চিকিৎসা সেবা, উচ্চ শিক্ষা, ব্যবসার খোঁজ খবর ও দর্শনীয় স্থান ঘুরতে প্রতিবছর কেবল বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর ব্যবহার করে ২০ থেকে ২২ লাখ পাসপোর্টধারী ভারতে যাতায়াত করে থাকে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে বেনাপোল বন্দর ব্যবহার করেছে ১৯ লাখ ৮৫ হাজার ৪০৭ জন। যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে ছিল ১৯ লাখ ৯৮ হাজার ৪৪৭ জন। এক্ষেত্রে যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে ১৩ হাজার ৪০ জন। এ খাত থেকে ভিসা ফি বাবদ বেনাপোল ইমিগ্রেশন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ভারতীয় দূতাবাস বছরে ১২০ কোটি টাকার বেশি আয় করে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা প্রয়োজনীয় কাজ মেটাতে বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কেবল বেনাপোল বন্দর হয়ে ভারতে নিয়ে খরচ করছে। আরও ভারতের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে বড় বাণিজ্যিক সম্পর্ক। বছরে প্রায় ১৪ মার্কিন বিলিয়ন ডলারের আমদানি ও ২ মার্কিন বিলিয়ন ডলারের রফতানি বাণিজ্য হয়।

এত বড় সম্পর্ক যে দেশের সাথে তাদের দেশের ভিসা প্রাপ্তি ও ভ্রমণের ক্ষেত্রে নানান কঠিন শর্তে দিন দিন নাজেহাল হতে হচ্ছে অসহায় বাংলাদেশিদের। কাগজপত্র ঠিক থাকলেও মায়ের ভিসা দিলে তো সাথে বাচ্চার ভিসা অনেক সময় লাগেনা। কিন্তু এক্ষেত্রেও আবার আবেদন করতে হচ্ছে। এছাড়া মেডিকেল ভিসার ক্ষেত্রে ৬ মাসের ভিসা দিলেও অনেক সময় একবার ভ্রমণের সুযোগ মিলছে। এতে চিকিৎসা সম্পূর্ণ হচ্ছেনা। পরে আবার ভিসা করাতে বা দীর্ঘ সময় ভারতে থেকে চিকিৎসা শেষ করতে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশিদের। এবং ৬ মাসের মাল্টিপল ট্যুরিষ্ট ভিসায় মাসে ২ বারের বেশি ভ্রমণ করা যায়না পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন দিয়ে। আবার অনেক সময় দেখা যায় বিজনেস ভিসায় ঘন ঘন গেলে নানান কৈফিয়ত দিতে হয়। অথচ ভারতীয় পাসপোর্টধারী এধরনের কোন শর্ত বা হেনস্তা ছাড়া অনায়াসে ব্যবসা, চাকুরী বা স্বজনদের সাথে সময় কাটাতে আসতে পারেন বাংলাদেশে। 

পাসপোর্টধারী যাত্রী আব্দুর রহমান জানান, মেডিকেল ভিসায় আগে চিকিৎসার জন্য ডাক্তার বুকিং নিয়ে সেই ডাক্তার বা অন্য ডাক্তার দেখানোর ক্ষেত্রে কোন বিধি নিষেধ ছিলনা। তবে এখন থেকে নির্দিষ্ট ওই ডাক্তারের থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে এমন কঠিন শর্তে বাংলাদেশিদের হয়রানির ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। চিকিৎসার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আয় বাড়াতে ভারতীয় দূতাবাস এ পন্থা অবলম্বন করছেন বলে জানান তিনি।

পাসপোর্টধারী রতন সরকার জানান, দেশে দুর্বল চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে বাধ্য হয়ে ভারতে যেতে হয়। এছাড়া পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনে জনবল সংকটে এক এক জনকে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা লাইনে দাড়াতে হয়। ভারত বন্ধু দেশ। তারা বাংলাদেশিদের চিকিৎসা সেবা সহজ করতে কঠিন এ শর্ত প্রত্যাহার ও যাত্রা সহজ করতে আন্তরিক হবেন এমনটি প্রত্যাশা করেন তিনি।

আরও কিছু পাসপোর্টধারীদের সাথে কথা বললে তারা অভিযোগ জানান, ভারতে মেডিকেল ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমার সিরিয়াল নিতে যদি ২ মাস অপেক্ষা করতে হয় তবে জরুরী চিকিৎসা কিভাবে পাবো।

ট্রাভেলস ব্যবসায়ী বেনাপোলের উজ্বল বিশ্বাস জানান, ভারতে যাত্রী যাতায়াত বাড়লেও তারা সেবার মান বাড়ায়নি। পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন সারতে এক এক জনের ৩ ঘণ্টার বেশি লাইনে দাড়াতে হয়। সেবা বাড়াতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক বৈঠকে অনেক অনুরোধ জানালেও এখন পর্যন্ত তারা কথা রাখেনি।

বেনাপোল বন্দর পরিচালক রেজাউল করিম জানান, যাত্রীরা দ্রুত বেনাপোল বন্দর পার হলেও পেট্রাপোল বন্দরে কিছুটা ভোগান্তি হয়। তবে সেবা বাড়াতে সম্প্রতি তাদের আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা আশ্বস্ত করেছেন আমাদের।।

এ সম্পর্কিত আরও খবর