ঘরবাড়ি হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে বানভাসিরা

, জাতীয়

মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী | 2024-07-03 18:09:38

ফুলগাজীতে মুহুরী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে ভেসে গেছে উত্তর দৌলতপুরের নুরুল করিমের ঘর। সোমবার (১ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টার দিকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাঁধ ভাঙা পানির তোড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় টিনের ঘর। ঘর ধ্বসে চাল নেমে আসে মাটিতে। যে কয়টি আসবাবপত্র ছিল তা পাওয়া গেল বন্যার প্রবাহমান পানিতে। রাজমিস্ত্রী নুরুল করিমের নতুন করে ঘর তৈরি করার সাধ্য নেই। ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে এখন যেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে খুব কাছ থেকে দেখছেন।

বুধবার (৩ জুলাই) বন্যায় নিজের ক্ষতি প্রসঙ্গে এসব কথা বলেন নুরুল করিম। নুরুল করিমের মতো এমন অবস্থা এলাকার অধিকাংশ মানুষের। বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি তাদের।

নুরুল করিম ঢাকা একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন। অর্ধ শতাব্দী আগে ফেনী সদরের ধর্মপুর এলাকা থেকে ভাগ্যের অন্বেষণে দৌলতপুরে আসেন নুরুল করিমের বাবা। ৪ শতাংশ জায়গায় বসতি স্থাপন করেন। বন্যায় ভিটামাটি হারিয়ে আবার পথে নেমেছেন তিনি।

সহায় সম্বলহীন হয়ে নুরুল করিম বলেন, সোমবার বিকেলে স্ত্রীর ফোন পেয়ে রাত আড়াইটায় বাড়িতে এসে দেখি দুই সন্তানকে নিয়ে আমার স্ত্রী নদীর দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছেন।

নুরুল করিমের মত দুঃখী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা। নুরুল করিমের বাড়িতে যান উপজেলা চেয়ারম্যান মো. হারুন মজুমদার। নুরুল করিম জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান স্থানীয়ভাবে বাসা ভাড়া করে থাকতে বলেছেন। ঘরের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি বাসা ভাড়া মেটাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

চলতি বছরে আরও একবার মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে ফের দুর্গতিতে পড়েছেন এ এলাকার মানুষরা। দীর্ঘ বছর ধরে বাঁধ ভাঙা-আর মেরামতের বৃত্তে জীবন কাটছে তাদের।


‘ঢল আইবো আর যাইবো, লাভ অইবো হেতেরগো। আন্ডা মইদ্দে হড়ি পিষি যাইয়ের, ক্ষেত করি আর লাভ নাই। হগগল জিনিসের দাম বেশি, আন্ডা দাম কমি গেছে’- এভাবে ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে নিজেদের অবস্থা প্রকাশ করেন স্থানীয় আরেক কৃষক আবদুল খালেক।

প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ভারতের উজানের পানিতে মুহুরী, কুহুয়া এবং সিলোনিয়া নদীর বাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে ফুলগাজী-পরশুরাম উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। অবকাঠামো ও কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এসব অঞ্চলে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যানুযায়ী, ২০১২-২০২২ সাল পর্যন্ত এক দশকে বন্যায় ফুলগাজীতে ৪০৩ একর জমির ধান ও সবজি আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সময়ে ১২৬ হেক্টর জলাশয়ে ৪৬৮ টন মাছ ভেসে গেছে। শত বছরের হিসেব করলে তা দাঁড়াবে বিশাল অঙ্কে।

বন্যার পানির প্রবল তোড়ে ঘরের সব মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ দৌলতপুর গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী ছকিনা আক্তারের ঘরে। তিনি জানান, রান্না করার পাতিল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী দুই সন্তান নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে ফিরছি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সোমবার রাত থেকে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। ১৯৮৮ সালের পরে এত বড় বন্যা আমি আর দেখি নাই।

মুহুরী নদীর বাঁধ নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই। তাদের ভাষ্যমতে, বন্যাকবলিত মানুষের কষ্ট দেখতে গণমাধ্যমে নিয়মিত সংবাদ হয়, ত্রাণের পরিধি বাড়ে। কিন্তু যখন পানি নেমে যায় তখন বন্যাকবলিত মানুষগুলোর খোঁজ কেউ নেয় না। জীবিকার তাগিদে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ নিয়ে আবার সংগ্রাম শুরু করতে হয়। বছরের পর বছর ধরে চলছে এ দুর্ভোগ।

উত্তর দৌলতপুরের সত্তোরর্ধ বৃদ্ধ আবুল কালাম জানান, বাঁধ ভেঙে ঘরে পানি ঢুকে গেছে। আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। দুই ছেলে মেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে গতকাল রাত থেকে দুর্ভোগে আছি।

আবহাওয়া অধিদফতর তথ্যানুযায়ী, আগামী পাঁচ দিন পর বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে। বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, পানির চাপে মুহুরী নদী আরও বাড়তে পারে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর