বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না বন্যার্তরা

, জাতীয়

কল্লোল রায়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুড়িগ্রাম | 2024-07-05 07:30:53

উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর অববাহিকা প্লাবিত হয়ে জেলার ৭ উপজেলার ৪১ টি ইউনিয়নের প্রায় ১৫ হাজার পরিবারের প্রায় ৮২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় নিম্নাঞ্চলের বাসিন্দারাও বন্যার কবলে পড়েছে। এ অবস্থায় সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম বাড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। 

তবে, বন্যায় বাড়ি ডুবে গেলেও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মানুষদের যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছেনা। সংসারের শেষ সম্বলটুকু হারানো ও ভেসে যাওয়ার ভয়ে ডুবে থাকা বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতেও নারাজ পরিবারগুলো। চেষ্টা করছেন ভেসে থাকা টিনের চালা আকড়ে ধরে বাঁচার।

উলিপুরে বন্যার্ত এক খামারির বাড়িতে রাখা গবাদি পশু। 

জেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান শাখা জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কুড়িগ্রামের প্রায় ৩২০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য ৪০৪টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু রয়েছে। কিন্তু সরকারি হিসেব মতে বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যা পর্যন্ত একটি মাত্র আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু পরিবার থাকার কথা জানিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান শাখা। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের প্রথম আলোর চর আলোর পাঠশালা নামের ঐ আশ্রয়কেন্দ্রে ১২টি পরিবার ও কিছু গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রিত ঐ পরিবারগুলো নদী ভাঙ্গনে ভিটেমাটি হারিয়ে সেখানে উঠেছেন। অপরদিকে, বন্যায় কবলিত পরিবারগুলোর আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রবণতা নেই বললেই চলে।

কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের কয়েকটি বন্যা কবলিত চরে সরেজমিনে গিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে না যেতে চাওয়ার ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করে বার্তা ২৪. কম। দেখা যায়, যাদের বাড়ি সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছে তারা নিকটবর্তী কোন উঁচু স্থানের আত্মীয়র বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। এবং যাদের বাড়ির টিনের চালা সহ কিছুটা অংশ ভেসে আছে সেখানে কোনমতে কষ্ট করে দিন পার করছেন চরাঞ্চলের বাসীন্দারা। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন টিনের চালায়, কেউবা নৌকাতেই কাটাচ্ছেন দিনরাত।

উলিপুর উপজেলার বতুয়াতুলি মুসার চরের বাসীন্দা নূর জামাল মিয়া। দুজন শ্রমিক ডেকে এনে ঘরের ভেতর গলা পর্যন্ত ওঠা পানিতে আসবাবপত্র ও বিভিন্ন জিনিসপত্র আরও উঁচুতে বেঁধে রাখছেন তিনি। পাশের উঁচু একটি টিলায় হাঁটু পানিতে গবাদিপশু গাদাগাদি করে রাখা। সারাদিন আঙিনায় বেঁধে রাখা নৌকায় বসে কাটছে তার দিন।

মুসার চর এলাকার বন্যা কবলিত এক বাসিন্দা। 

আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বাড়ির সব মালামাল নিয়ে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। পানি বাড়লে জিনিসপত্র আরও উঁচুতে তুলতে হয়। বাড়িতে না থাকলে সব ভেসে যাবে। সেখানে গরু গুলোর যায়গা হবে কিনে কে জানে। মালামাল রক্ষা করতে আমাদের বাড়িতেই থাকতে হয়।

একই চরের বাসিন্দা ফাতেমা বেগমের কন্ঠেও একই ব্যাখ্যা। বাড়ির ৩ টি ঘরে বুক পর্যন্ত পানি ওঠার পর ৬টি গরুসহ ৫ জন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাড়ির একটি উঁচু টিলায় আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। সেখানেই চলে রান্নার কাজ। তিনি বলছিলেন, খাওয়ার কষ্ট, টয়লেট যাওয়ার কষ্ট, থাকার কষ্ট। তারপরেও চোখের সামনে বাড়িটা আছে এটাই শান্তি। এগুলো ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে সবসময় টেনশন হবে। সেখানেও থাকার ব্যবস্থা কেমন সেটা নিয়েও চিন্তা হয়।

কুড়িগ্রামের কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেখানে দুই একটি করে পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন এবং মানুষের থেকে গবদি পশুর সংখ্যাই বেশি। উলিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আতাউর রহমান জানিয়েছেন, উলিপুরের চর বাগুয়াতে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এর আশেপাশের কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশুর পাশাপাশি দু-একটি করে পরিবার উঠেছে।

কুড়িগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল হাই সরকার বলেন, আমরা সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় মোট ৪০৪ টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি। সেখানে মানুষদের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের আসার জন্য বারবার বলা হচ্ছে। সাধারণত চরম ঝুঁকি না মনে করলে লোকজন আসতে চায়না। তবে আমরা সবসময় প্রস্তুত আছি।

এদিকে, সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম বাড়িয়েছে জেলা প্রশাসন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলায় মোট ১০৫ মে. টন চাল, ৪ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার ও নগদ ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যা ৬টায় চিলমারী ও নুনখাওয়া পয়েন্টে এই ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার যথাক্রমে ৭১ সেন্টিমিটার ও ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি আগামী ৩ দিন পর্যন্ত পানি বৃদ্ধির হার অব্যহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র।

এ সম্পর্কিত আরও খবর