১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘....তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব; ইনশাআল্লাহ।’
দাবায় রাখতে পারেনি তারা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন দুনিয়ার অন্যতম পরাক্রমশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের দামাল তরুণদের কাছে হার মেনেছিল।
৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও বীরত্বে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিল বাঙালি জাতি। চিরসংগ্রামী ও বিদ্রোহী বাঙালি জাতি এবং এই ভূখণ্ডের অন্যান্য নৃগোষ্ঠী প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী বিজয়ের দিনটি তাই গোটা বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসেই অনন্য মাইলফলক।
পঞ্জিকা ঘুরে আবারো আমাদের সামনে এসেছে ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পূর্তি। স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরে খেরোখাতা খুলে বসলে দেখা যায়, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির টানাপোড়েনের মধ্যে, শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে প্রিয় মাতৃভূমি।
মাত্র ২১ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। এক কবিতায় তিনি বলেছিলেন—
‘শাবাশ, বাংলাদেশ,
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়;
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার,
তবু মাথা নোয়াবার নয়।’
কবিতার লাইনগুলোর জ্বলজ্যন্ত প্রমাণ ১৯৭১ সালের বিজয় অর্জন। বিশ্বাবাসীর বিস্মিত চোখের সামনে রক্তের দামে কেনা স্বাধীনতা অর্জনেই শুধু নয়; পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ একের পর এক আরও বিস্ময় সৃষ্টি করে চলছে।
সত্তরের দশকে যে দেশকে নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের মন্তব্য ছিল ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’; সেই দেশ আজ বিশ্বমোড়লদের চোখে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’। বিশ্বের সামনে এখন স্বার্বভৌম, স্বনির্ভরতা ও সমৃদ্ধির সমুজ্জ্বল উদাহরণ।
স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বৈষম্যহীনতার যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, সেটাও এখন হাতের নাগালে। বাংলাদেশ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দৃশ্যমান অর্জনও করেছে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ এখন উন্নত বাংলাদেশ হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ধীরে কিন্তু দৃপ্ত পদক্ষেপে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
এক সময় বৈদেশিক অনুদান ও ঋণ ছাড়া যেখানে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন অকল্পনীয় ছিল। এখন সেখানে নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি হওয়া পদ্মা বহুমুখী সেতুর মতো মেগা প্রকল্পও প্রমত্ত পদ্মার বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতার জয়গান গাইছে।
পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান অবকাঠামো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা আমাদের স্বপ্ন ছিল নিঃসন্দেহে, একই সঙ্গে প্রত্যয় ছিল সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।
ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প,দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প, কয়লা ভিত্তিক রামপাল থার্মাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প এবং সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ প্রকল্পসহ অনেক মেগা প্রকল্প এখন আর স্বপ্ন নয় বরং রঙিন বাস্তবতা।
জল, স্থল ও অন্তঃরীক্ষ সবাখানেই এখন বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল বিচরণ!
মহাকাশে দেশের বিজয় তিলক হিসেবে শোভা পাচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলইট-১’। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে থাকা দীর্ঘ দিনের বিরোধ মিটে গেছে। ফলশ্রুতিতে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার নিয়ে বিশাল সমুদ্রসীমায় এখন বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। যা খুলে দিয়েছে `ব্লু ইকোনোমি’র অপার সম্ভাবনা। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর দেশের সীমানা নির্ধারণ হয়েছে ২০১৫ সালে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৫০ একর জমি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল প্রতিবেশী দেশে। এখন বাংলাদেশ নিজেই দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর আশ্রয়, খাদ্য ও নিরাপত্তা দিচ্ছে। জাতি হিসেবে বিশ্বে একটি মর্যাদার আসনে নিজেদের তুলে ধরেছে।
দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রূপকল্প-২০২১ এর লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করতে চায় সরকার। যাতে জাতির পিতার স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার পথে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়।
দেশের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী বছর শুরু হতে যাচ্ছে ‘মুজিব বর্ষ’। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত বছরব্যাপী নানা কর্মসূচিতে উদযাপন করা হবে মুজিব বর্ষ। মুজিব বর্ষের প্রাক্কালে এবারের বিজয় দিবস আমাদের জন্য বিশেষ মাত্রা বহন করছে। মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী প্রেরণা, আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বঐতিহ্য। যে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়েছিল সে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু যেন নতুন রূপে আর্বিভূত হতে যাচ্ছে মুজিব বর্ষে।
আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। যে রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র হবে গণতন্ত্র, যে রাষ্ট্রে জাতি বর্ণ-ধর্ম-নির্বিশেষে সব মানুষ মুক্তির আস্বাদ নিয়ে বসবাস করবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল, ভুল ইতিহাস আর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের ক্ষমতায় আরোহণে দেশের লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার চোখে নীরব অশ্রু গড়াতো।
যদিও সে পরিস্থিতিও এখন আর নেই। গত কয়েক বছর ধরেই আমরা দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারা ও চেতনায় ফিরতে দেখে আসছি। একদিকে যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া অনেকাংশে সম্পন্ন হয়েছে। তবুও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ এখনও নানা নামে-বেনামে একাত্তরের মতোই রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত। তারা সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টের পাঁয়তারা করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায়বিচারভিত্তিক যে বাংলাদেশ গঠনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখেছিলেন সেই চেতনার মূলে আঘাত করে চলছে এসব অন্ধকারের শক্তি।
আমরা প্রত্যাশা করি, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িকতার পথে সব বাধা দূর হয়ে, সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা নিশ্চিতের মাধ্যমে মুক্তি ও স্বাধীনতার নতুন চেতনায় আলোকিত বাংলাদেশের বিজয় কেতন উড়বে বিশ্ব পরিমণ্ডলে। সেই বাংলাদেশকে আর কেউ দাবায় রাখতে পারবে না।