ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো: বিদায়েও ম্লান হয় না অর্জন

, খেলা

কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-07-06 18:03:14

ম্যাচ শুরুর আগে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরে মাঠে এসেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও কিলিয়ান এমবাপে। দুজনের মুষ্টিবদ্ধ হাতের দৃশ্য, মাঠের মুখোমুখি লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি, ছিল সবকিছু। এর সবটা আড়াল পড়ে যায় বুঝি কিলিয়ান এমবাপের চাহনি। শৈশবের নায়কের প্রতি মুগ্ধতা। মুহূর্ত খানিক বাদে যারা একে অপরের প্রবল প্রতিপক্ষ, তবু এমবাপের চোখ বলছিল মনের কথাটা। কতটা শ্রদ্ধা থাকলে চোখ দিয়েও ঠিকরে বেরিয়ে আসে তা।

কিলিয়ান এমবাপে বিশ্বকাপ জেতা ফুটবলার। বৈশ্বিক ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরে কেবল দলীয় অর্জনেই নয়, ব্যক্তিগত অর্জনেও ভাস্বর তার ক্যারিয়ার। যখনই সুযোগ আসে, তখনই অকপটে বলে থাকেন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোই তার ‘আইডল’। আইডলের বিপক্ষে মাঠে নামার আগের দিনের সংবাদ সম্মেলনে সে একই কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন। বললেন, কিংবদন্তি ক্রিশ্চিয়ানোর বিপক্ষে খেলা সম্মানের। আগে কী হয়েছে, পরে কী হবে, এটা কোন বিষয়ই নয়; ক্রিশ্চিয়ানো সব সময়ই এ খেলার কিংবদন্তি থাকবে।

রোনালদো বিশ্বকাপ জেতেননি। এরবাইরে সম্ভাব্য সব ট্রফি জিতেছেন তিনি। ইউরো জিতেছেন, উয়েফা নেশন্স লিগ জিতেছেন। নিজেকে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাতে তিনিই সর্বকালের সেরা ফুটবলার কিনা এনিয়ে তর্ক হয়, বিতর্ক হয়। তবে ফুটবল যেখানে বিশাল এক ক্রীড়া মাধ্যম সেখানে স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের ফুটবলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো একটা নির্দিষ্ট ধারা তৈরি করেছেন, যেখানে তাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয় অনেক কিছুই। তিনি একটা প্রজন্মকে সঙ্গে নিয়ে পর্তুগালকে বিশ্বফুটবলের অন্যতম শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইউসেবিও-ফিগোরা পর্তুগাল ফুটবলের অন্যতম নাম হলেও তারা দলকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেননি, যা করেছেন রোনালদো।

বিশ্বের দেশে-দেশের ফুটবলারের কাছে আইডল একজন রোনালদোই। তার ‘সিউ-উ-উ’ উদযাপন, কিংবা ‘কালমা-কালমা’ কেবল ফুটবলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটা সঞ্চারিত হয়েছে ক্রিকেটসহ আরও অনেক খেলায়। ক্রিকেট মাঠেও আমরা দেখছি এখন সিউ-উ-উ উদযাপন। এই সিউ-উ-উ ধ্বনি উচ্চারিত হয় গ্যালারি থেকে। রোনালদোর এই সময়ের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা দলের ফুটবলার আনসান্দ্রো গারনাচো কোন রাখঢাক না রেখে স্বীকার করেন, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তার আইডল। গারনাচোর এই বক্তব্যে আর্জেন্টিনার সহখেলোয়ায়াড়েরা সংক্ষুব্ধ হলেও অনতিতরুণ গারনাচো সেটাকে পাত্তাই দেন না।

এই ইউরোতেও আমরা দেখেছি জর্জিয়ার ফুটবলার কাভিচা কাভারাৎসখেলিয়া পর্তুগালের বিপক্ষে ম্যাচ জয়ের দিনে কেবল রোনালদোকে দেখেই জয়ের উদযাপন বাদ দিয়ে তার আইডলের কাছ থেকে জার্সি চেয়ে নিয়েছেন। এরপর সামাজিক মাধ্যমে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচের ট্রফির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন রোনালদোর জার্সি, নিজে পরে হাত দিয়ে দেখিয়েছেন ৭ নম্বর জার্সি ও রোনালদোর নাম। ইতিহাস গড়া জয়ের চাইতে বড় এখানে হয়ে গেছে তার আইডলের জার্সি ও সঙ্গ উপভোগ। নিজেকে কী উচ্চতায় নিয়ে গেলে এমন অভাবনীয় সম্মান অর্জন সম্ভব, রোনালদো এটা প্রমাণ করেছেন।

রোনালদোর বয়স এখন ৩৯। এই বয়সেও ফুটবল মাঠে সেই একইভাবে জয়ের জন্যে মরিয়া তিনি। ইউরোপের ফুটবল ছেড়ে বর্তমানে খেলছেন তিনি সৌদি প্রো লিগে। এশিয়ার দেশটির ফুটবল বদলে দেওয়ার পথ দেখেছে লিগে তার অন্তর্ভুক্তিতে। তার পর সৌদি ফুটবলে তারকাদের মেলা বসেছে। এনগেলো কন্তে, করিম বেনজেমা, নেইমার, রিয়াদ মাহারেজ, সাদিও মানে, রবের্ত ফিরমিনোসহ ইউরোপের মাঠ মাতানো ফুটবলাররা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সৌদি প্রো লিগ। এটা সম্ভব হয়েছে তার কারণেই। তার কারণে ফুটবল থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে সৌদি সরকার। সম্প্রতি সৌদি সরকার ঘোষণা দিয়েছে ফুটবল ক্লাবগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার, যাতে আরও বেশি রাজস্ব আসে এই খাত থেকে। নামের ওজনে তিনি কেবল সৌদি ফুটবলকে বদলাননি, সদ্য সমাপ্ত মৌসুমেও করে গেছেন একের পর এক গোল।

এবারের ইউরো ছিল রোনালদোর ষষ্ঠ। ইউরোর ইতিহাসে সর্বোচ্চ গোলদাতা এবার পাঁচ ম্যাচ খেলে থাকলেন গোলহীন। কোন টুর্নামেন্টে এমনটা আগে ঘটেনি, এবার ঘটল যা। গোলমুখে পঁচিশের বেশি শট নিয়েও বল যায়নি জালে। এর ওপর করেছেন একটি পেনাল্টি মিসও। শেষ ষোলোর ম্যাচে স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে ইয়ান ওবলাক তার শট ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। ওই ম্যাচও গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে, যেখানে দিয়েগো কস্তার অতিমানবীয় পারফরম্যান্সে পর্তুগাল ওঠেছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। টাইব্রেকারে যদিও প্রথম শটে গোল করেছিলেন সেই রোনালদোই, তবে ওই পেনাল্টি মিস তাকে পুড়িয়েছে, দলকে পুড়িয়েছে, সমর্থকদের পুড়িয়েছে। কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে রোনালদো-বিদ্বেষীদের, যার প্রভাব ছিল কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচেও। ফ্রান্সের বিপক্ষে রোনালদো মাঠে ছিলেন ঠিক, কিন্তু থেকেও যেন নেই। তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন দলের কোচ রবের্ত মার্তিনেজ ও সহখেলোয়াড়েরা। কিন্তু ফুটবল এমনই যেখানে সবকিছু সবসময় মনের মতো হয় না, রোনালদোর হয়নি, পর্তুগালের হয়নি।

ফ্রান্সের বিপক্ষে মাঠে নিষ্প্রভ ছিলেন রোনালদো। মাঠের বাইরে সরব ছিল তার আলোচনা। ফুরিয়ে গেছেন, ক্যারিয়ার শেষ এই আলোচনা জোরদার হয়েছে। এটাই শেষ ইউরো তার, এই ঘোষণা দিয়েছিলেন আগে; তবে ইউরো থেকে বিদায়ের দিন থেকেই আলোচিত হচ্ছে তার জাতীয় দলের ক্যারিয়ারের শেষের আলোচনা। ঘোষণা যদিও আসেনি, তবে ধারণা করা হচ্ছে পর্তুগালের হয়ে খেলা নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ত নিতে যাচ্ছেন তিনি শিগগিরই।

আজীবন স্রোতের বিপক্ষে সংগ্রাম করে এই পর্যায়ে ওঠে এসেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ৭ নম্বর জার্সির ব্যান্ডভ্যালু তৈরি হয়েছে তার কারণেই। ফুটবলবিশ্ব জানে ৭ নম্বর জার্সি মানেই ‘সিআর সেভেন’। পেলে-ম্যারাডোনারা ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলতেন বলে ওটা মহিমান্বিত। বিতর্কসাপেক্ষ সর্বকালের শীর্ষ দুই ফুটবলার পেলে-ম্যারাডোনার কারণে ১০ নম্বর জার্সি পেয়েছিল আলাদা মর্যাদা। এই ১০ নম্বর জার্সির বাইরে ৭ নম্বর জার্সিটাকে আলাদা মর্যাদা এনে দিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোই। বিশ্বে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফুটবলের যে জনপ্রিয়তা সেটার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন পেলে-ম্যারাডোনা, কিন্তু পর্তুগালকে চিনিয়েছেন একজনই, পর্তুগালকে ফুটবলশক্তি করেছেন একজনই; তিনি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দলে ওই দুই কিংবদন্তির বাইরে আরও যত এসেছেন, আসবেন তাদেরকে লড়তে হয় পেলে-ম্যারাডোনার ছায়ার সঙ্গে। লিওনেল মেসি, কিংবা নেইমারও এর ব্যতিক্রম নন। তবে এখানে অনন্য ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। একুশ শতকের এক ফুটবলার নিজে গড়েছেন দেশের ফুটবল সৌধ, পেয়েছেন অমরত্ব।

কিংবদন্তিরও নীড়ে ফেরার সময় হয়। তারাও বুড়িয়ে যায়। তাদেরও পারফরম্যান্সে ভাটা পড়ে। তারাও ‘মানুষ’। আর মানুষ বলেই উনচল্লিশে এসে শরীর কথা বলে না উনিশের। তৈরি হয় বিদায়ের প্লট। কঠিন সেই বাস্তবতার সামনে এখন রোনালদো। হেরে-কেঁদে-হতাশায় বিদায় নিচ্ছেন রোনালদো। এই কান্নায় বাস্তবতা আর সাময়িক ব্যর্থতার গল্প আছে ঠিক, কিন্তু তার পাশাপাশি সগৌরবে উঁকি দেয় সমূহ অর্জন।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, বিদায়ে ম্লান হয়নি আপনার অর্জন; বরং তা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। ফুটবলকে আপনি ঋদ্ধ করেছেন, হয়েছেন ফুটবল গবেষণার প্রপঞ্চ।

এ সম্পর্কিত আরও খবর