লাশকাটা ঘরে জ্বলে মোমবাতি!
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) মর্গের লাশকাটা ঘরে রয়েছে ১৩টি টিউব লাইট ও ৯টি বাল্ব। তবে তার একটিও জ্বলে না! বৈদ্যুতিক বাতি অকেজো হয়ে পড়ে থাকায় বাধ্য হয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে মরদেহের ময়নাতদন্ত কাজ করা হয়। আবার অনেক সময় যারা লাশ কাটেন তারা অস্থায়ী বাল্ব জ্বালিয়ে কাজ করেন। এতে করে দেখা যায় ময়নাতদন্তের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রায়ই অন্ধকারে করা হয়। এর ফলে অনেক সময় প্রতিবেদনে উঠে আসে না মৃত্যুর সঠিক কারণ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৬ সালে রাজশাহীর অভিজাত একটি হোটেল থেকে দুই তরুণ-তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়। সেই লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেন রামেকের ফরেনসিক বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ডা. এনামুল হক।
তবে তার ওই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যুক্ত করে দেওয়া চার্জশিটে সন্তুষ্ট হতে পারেননি আদালত। ফলে পুনরায় মামলা তদন্ত করা হয়। পরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে আসে তাদের নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা।
ভুল ময়নাতদন্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে রামেকের ফরেনসিক বিভাগের সদ্য সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. এনামুল হক বলেন, ‘আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। আমি যখন অবসরে যাই, তখনও প্রায় ৩০০টির মতো ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন জমা ছিল। যেগুলো দিয়ে আসতে পারিনি। লাশকাটার ঘরে বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলে না। টর্চ লাইটের আলোতে প্রায়ই লাশ কাটতে হয়েছে। কখনও বা মোমবাতি জ্বালিয়ে কাটতে হয়েছে। যার ফলে প্রতিবেদন ভুল হতে পারে। সেটিকে (ভুল তথ্য) আমি অস্বাভাবিক মনে করি না!’
এদিকে, বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) সরেজমিনে রামেক মর্গের লাশকাটা ঘরে গিয়ে দেখা যায় দুইজন ব্যক্তির ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- নওগাঁর বদলগাছির শফিকুল ইসলাম ও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার অলিক চাকির। তার দু’জনই অ্যালকোহল পানে মারা গেছেন বলে জানা যায়।
লাশকাটা ঘরে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে টিউব লাইট রয়েছে ১৩টি। এনার্জি বাল্ব ৯টি। ফ্যানের সংখ্যা ১৬টি। এগুলোর সুইচ অন করে দেখা যায়- একটি বাল্বও ঠিক নেই। সবগুলো অকেজো। ১৬টি ফ্যানের মধ্যে ১৩টিই অকেজো।
তবে বোর্ডের সঙ্গে সুইচ নেই এমন একটি ছোট এনার্জি বাল্ব জ্বলতে দেখা যায়। সেটি তিন থেকে চার গজের একটি তার দিয়ে পৃথক একটি বোর্ডে সকেটের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেই স্বল্প আলোতে লাশের সেলাই করছিলেন রনি নামে এক যুবক।
রনি জানালেন, তিনিই এই লাইটের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ চলে গেলে সেটিও অফ হয়ে যায়। তখন মোমবাতি জ্বালিয়ে নেন। ফ্যান অকেজো থাকায় প্রচণ্ড গরমে লাশ কাটা ও সেলাইয়ের কাজ করতে হয়। ফলে মন স্থির রেখে কাজ করা সম্ভব হয় না।
লাশকাটা ঘরের ভেতরে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বসার জন্য কয়েক সারি বেঞ্চ রাখা রয়েছে। ময়নাতদন্তের বিষয়ে এখানে তাদের হাতেকলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্যান চলে না বলে গরমের সময় তারা সেখানে গিয়ে বসতে পারেন না। গরমের মধ্যে লাশ কাটা হলে প্রচণ্ড দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। ফলে শিক্ষার্থীরা সেখানে বসতে পারেন না।
মর্গে লাশ কাটেন অখিলেশ নামে এক ব্যক্তি। তিনি জানান, সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ময়নাতদন্ত করা হয়। বিকাল ৪টার পর কোনো লাশ এলে আগামী দিনের জন্য রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু লাশ রাখার ফ্রিজ কয়েক বছর ধরেই নষ্ট। লাশকাটা ঘরে নেই পানির ব্যবস্থাও। লাশ কাটার পর রক্ত ধুয়ে ফেলতে দূর থেকে পানি আনতে হয় বালতিতে করে। এসব সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেকবারই মৌখিকভাবে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কিন্তু সমাধান হয়নি।
রামেক মর্গে তিন সপ্তাহ আগেও লাশের ময়নাতদন্ত করতেন ডা. মারুফুল আরেফিন। অসংখ্য লাশের ময়নাতদন্তের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। রামেকের লাশকাটা ঘরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা আদর্শ মর্গের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো পর্যাপ্ত আলো থাকা। কিন্তু রামেকের মর্গ আধুনিক মর্গের সংজ্ঞার ভেতরে পড়ে না। লাইট জ্বলে না, ফ্যান চলে না। শিক্ষার্থীদের মানবদেহের সবকিছু দেখানো যায় না। বিদ্যুৎ চলে গেলে মোমবাতি জ্বালাতে হয়। এমন পরিবেশে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ভুল আসাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই ফরেনসিক বিভাগের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতে হবে।
রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম বলেন, পুলিশের তদন্তে দেখা যায় খুন হয়েছে, অথচ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আত্মহত্যা। এমন অনেক ঘটনা আছে। এ রকম সময় আমরা বিষয়টি আদালতকে অবহিত করি। আদালত তখন দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের নির্দেশ দেন। তখন দেখা যায়, সত্যিই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হলে যেসব কারণে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ভুল আসে সেগুলো দূর করতে হবে।
রামেকের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কফিল উদ্দিন বলেন, ‘আমি দায়িত্বে এসেছি কিছু দিন হলো। মর্গে অনেক সমস্যা ছিলো। কিছু কাটিয়ে উঠেছি, কিছু সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। আমরা সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আশা করছি, ধীরে ধীরে সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব।