আমাদের বিষাদি আত্মাগণ সুখে থাকুক



এনামুল রেজা
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এমন হলে ভালো লাগে না। রিকশায় দশ নম্বর থেকে বাসায় ফিরবার সময় একটা প্রাইভেট কারের সামনে প্রায় উল্টে পড়েছিলাম। ট্যাক্সিটা রাস্তা ক্রস করতে চাইছিল, কিছু বুঝবার আগেই প্রায় ফাঁকা রাস্তায় চলন্ত রিকশার সামনে এসে ব্রেক করল। তাল সামলাতে না পেরে উড়ে গেলাম।

দামি গাড়ি, ফ্রন্ট ডোরের কিছুটা তুবড়ে যাওয়ায় ড্রাইভার যখন রিকশাঅলাকে মারতে উদ্যত হবে, বিস্ময় কাটিয়ে চিৎকার করে উঠেছিলাম, “আমার জীবনের দামের চেয়ে গাড়ির দাম বেশি নাকি মিয়া? দিয়েছিলেন তো পিষে আরেকটু হলে!” জানি না ওই চিৎকারে বিশেষ কিছু ছিল কিনা, ট্যাক্সির পেছনে বসা সফেসটিকেটেড ভদ্রলোক ভেতর থেকে বেরিয়ে নিজের ড্রাইভারকে শান্ত করলেন। খুব দ্রুতই একটা “হতে পারত” ধরনের ঝামেলা মিটে গেল। চারপাশ মুহূর্তে ঘিরে ফেলা লোকজন এদিক ওদিক চলে গেল হতাশ হয়ে, তারা গণ্ডগোলভুক, পৃথিবীর এ-প্রান্তে পথচারীদের সম্ভবত হাতে কোনো কাজ থাকে না, রাস্তায় কিছু ঘটলেই উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। রিকশাঅলা ঝড়ের গতিতে আমাকে নিয়ে বারো নম্বরের পথ ধরল।

মামা, যা থেরেটটা দিছিলেন না! নাইলে আজকে আমার খবর আছিল।
আপনি আরেকটু সাবধানে চালাবেন। হাইওয়েতে রিকশাকে কেউ গোনায় ধরে না।
আইজ আপনেই কন মামা, আমার দুষ ছিল কুনো?

রিকশাঅলার নাম জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল। একেকদিন করিও। টুকটাক সামাজিক-রাজনৈতিক আলাপ ওদের সঙ্গে করতে ভালো লাগে। এই যে মেট্রোরেল হচ্ছে, মায়ানগরের পথঘাট পরিণত হচ্ছে খানাখন্দে, এসব নিয়ে দেখা যায় ওরা বেশ তথ্য রাখে। বেশিরভাগই সরেজমিন মন্তব্য। হয়তো নির্মাণ শ্রমিকদের কাছ থেকে ওরা তথ্যগুলো পায়। প্রতি পিলারে কয় গাড়ি সিমেন্ট লাগে, কোথায় কত বড় চুরি হচ্ছে, কবে নাগাদ এই যজ্ঞ শেষ হতে পারে। কেউ কেউ আবার দারুণ সরকার-ভক্ত। নিয়মিত আমাদের লাইনের মাথা থেকে রিকশায় দশ নম্বরে যাই, এদিকটায় ওদের প্রায় সকলেই চেনে আমাকে। কিন্তু আজ আর কথা বিশেষ এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না।  

আসলে বুকের রক্ত ছলকে ওঠা ব্যাপারটা টের পেয়েছিলাম তো। এক মুহূর্তের এদিক ওদিকে কত কিনা হতে পারে।  কিভাবে ভারসাম্য ঠিক রাখলাম জানি না। রাস্তায় উল্টে না পড়ে একটা পল্টি খেয়েও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। এই ক্ষণিকের উড্ডয়ন ও পল্টিতে একটা সার্কাস ছিল সম্ভবত, সঙ্গে কিছু সাফল্যও। তাই কি অমন জোর পেয়েছিলাম কন্ঠে? জানি না।

বাসায় ফিরেছি বহুক্ষণ পেরিয়ে গেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে এ-সমস্ত ভাবছি। ফাঁকা ড্রয়িংরুমে এই রাতের প্রথম প্রহরেও গহন রজনীর নিস্তব্ধতা। বাইরে থেকে শব্দ আসছে খুব অল্প। মশার যন্ত্রণায় জানালাগুলো বন্ধ। এখন তো সারা বছর মশার যন্ত্রণা। কী চমৎকার বিবর্তন হয়েছে ব্যাটাদের। কয়েলে কাজ হয় না, গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত, সকল ঋতুতেই ওদের প্রজনন বহাল থাকে। টিভি অন করা যেতে পারে। যদিও টিভিতে এখন আর দেখার মতো প্রোগ্রাম কই হয়?

আমি সম্ভবত বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি এ সাতাশেই। বেঁচে থাকার দিনগুলোতে নানাভাই সারাদিন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আর এনিমল প্লানেটে বাঁদর-কুমির এইসব দেখত। ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল বুড়ো হলে এসব চ্যানেল দেখতে হয়। এখনো ধারণাটা বদলায়নি। এনিমল প্লানেট আর আসে না, আমাদের ডিশের লাইন খুব যা-তা ধরনের, থাকতে হয় তাই আছে। বিলও বেশি না, সম্ভবত দেড়শো টাকা দিতে হয় মাসে। আমি ন্যাটজিও আর ডিসকভারি চ্যানেল ছাড়া টিভিতে কিছু দেখবার মতো খুঁজে পাইনা। বিশেষত, বাঁদর বিষয়ক যে কোনো অনুষ্ঠান দারুণ লাগে, বাস্তবে বাঁদর দেখার মতো উত্তেজক না হলেও মন্দ না ততটা। শেষ কবে সাক্ষাৎ বাঁদর দেখেছি? মিরপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলাম। জাহাঙ্গীর গেট থেকে বাংলা-মটরের বাসে উঠব। জাহাঙ্গীর গেটের কিছু আগে দেয়াল ঘেরা একটা আর্মি কোয়ার্টারের বাগানে দেখলাম চার সদস্যের এক বাঁদর পরিবার জুলজুল করে চেয়ে আছে আমার দিকে। তাদের বসবাস এক ফলবতী কাঁঠাল গাছে, ওগুলোর গায়ের রঙও ছিল হলদেটে, কাঁঠালের মতন।

লীনা বাসায় নেই। এই না থাকাটার কারণ হয়তো কোনো নিমন্ত্রণ। কারো বিয়ে বা কারো সন্তানের জন্মদিন, মুসলমানি ইত্যাদি। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে প্রায় একা একাই সবখানে যায় লীনা। এই সংসারে আমার থাকা-থাকিটা যান্ত্রিক। ছুটির দিন ছাড়া ওদের সঙ্গে তেমন কথা হয় না। সকালে অফিসের জন্য বের হয়ে যাই। সারাদিন কাটে কাজের মাঝে। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা কি নয়টা। ট্র্যাফিক জ্যাম, কোনো গাড়ি না পেয়ে দুই তিন কিলোমিটার হণ্টনের ক্লান্তি আমাকে অবশ করে দেয়। বেশিরভাগ দিনেই পারিজা ঘুমিয়ে পড়ে। লীনা আর আমার সংসার খুব বিমর্ষ ধরনের। মেয়েটা এসব দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছে। বড় হলে নিজেও হয়তো অবসন্ন আর বিষণ্ন এক মানুষ হবে। আজকাল এ-নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না আমরা কেউ। লীনা করে কিনা তা অবশ্য জানা নেই। আমাদের সঙ্গমে মরচে ধরে গিয়েছে।

বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করে ফেলাটা নিশ্চয়ই একটা বিপ্লবী ধরনের ঘটনা। লীনা আর আমার বিয়েটা ছিল ঘর-পলাতক। অবশ্য, আমার পালাবার দরকার হয়নি। ও-ই একদিন গাঁটছড়া বেঁধে সবকিছু নিয়ে আমার ঘাটে এসে ভিড়েছিল। খুব ক্রিটিকাল এক সময় তখন। নানাভাই ভীষণ অসুস্থ। যে কোনো দিন ঝরে যাবেন। আম্মা ঘুমাতে পারছেন না রাতের পর রাত, হাইস্কুল পড়ুয়া ছোটবোন ত্রপা আর কী বা সাহায্য করবে? আব্বার পোস্টিং তখনও মায়ানগরের বাইরে। একা একা কতদূর সামলানো যায়? এসবের মধ্যেই আমাদের প্রেম চলছিল। রেস্টুরেন্টে, রিকশায়, সোহরোয়ার্দী উদ্যান কিংবা পাবলিক বাসে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ছাড়পত্র মেলেনি কারো অথচ মনে হতো দারুণ বড় হয়ে উঠেছি। একদিন সুলতানের চিত্রকলার মতো প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক ভালোবাসা-বাসির সময় আমিই ওর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলেছিলাম, “আমাদের উচিত বিয়ে করে ফেলা।” লীনা হেসেছিল। ওর ঘেমে ওঠা নাকের ডগা, কাজল লেপ্টে যাওয়া চোখ আর অপ্রশস্ত কপালের রেখায় খেলা করতে শুরু করেছিল বিস্ময়।

এখনো আমরা পাশ করে বের হলাম না। বিয়ে যে করবে আমাকে, খাওয়াবে কী?
তোমার কি ধারণা আমি এখন কোনো চাকরি পাব না?
কী যে পাবে! আমার বাসায় রাজি হবে কেন তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে?
রাজি হওয়া লাগবে না লীনা। চলো আমরা নিজেরাই বিয়ে করে ফেলি।

অনুমেয়-ভাবেই কেউ রাজি হলো না ওদের বাসায়। আম্মা বললেন, বিয়ে করবি বেশ। তোর নানাভাইয়ের এমন অবস্থা, আমি একা মানুষ, তোর আব্বা শহরের বাইরে।  সময়টা আনন্দের না শিপন। ত্রপার এসএসসি আর ক’দিন বাদেই।  

মানুষ হিসেবে নিজেকে পলাতক মনে হয় আমার, চিরকাল। সব সঙ্কট থেকে গা বাঁচিয়ে কিভাবে ভালো থাকা যায়, এই চেষ্টা ছোট থেকেই করতাম।  নানাভাইকে যে আমি ভালোবাসতাম না, এমন নয়। সেই ভালোবাসা ছাপিয়ে আমার মনে হতো, নব্বই ছুঁই ছুঁই একজন বৃদ্ধ সহজ স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, সে দুঃখে নিজের জীবনের স্রোত আটকে দিলেই কি মানুষটা অমরত্ব পাবেন কিংবা অন্তত দশ বছরের বাড়তি আয়ু? বাসা থেকে লীনাকে জোর করে বিয়ে দেবার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। পাত্র হিসেবে আমার তেমন যোগ্যতা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বাংলা-সাহিত্য পড়ি, ভবিষ্যতে চাকুরির বাজারে তার কদর খুব সামান্য।  আর, আমাদের বয়সটা, আজ মনে হয়, ওই সময় বাইশ যেমনই থাকুক, আজকের চিন্তায় নিতান্তই কৈশোরকাল। গোঁফ-দাড়ি পেয়েছিলাম বংশগত কারণেই, আমাকে বেশ বড় দেখাত এটা অনুমান করি। আসলে আর কত বড় ছিলাম? তবু, ঘটনাটা আমার পক্ষে মোড় নিলে লীনা এক ঘোলাটে শীতের ভরদুপুরে একটা লাগেজ নিয়ে উঠে এসেছিল আমাদের বাসায়।  

যাক, ওসব মনে করে আর কী লাভ-ক্ষতি? ফলাফলের চিন্তা ঝেড়েই আমার মগজে অতীতের সুতীব্র সঙ্গীত দিনমান বাজতে থাকে। জীবন এমন নিস্তরঙ্গ হবে কখনো ভাবিনি। কোনো শঙ্কা নেই, ঢেউ বা প্রবল স্রোত নেই। এই পাঁচ বছর আগেও এত এত এক্সাইটমেন্ট যে পুষতাম বুকে, সেসব কি বেলুনে পোরা বাতাস ছিল? বেলুনটা ফুটো করে দিল কে? চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম। সাড়ে ন’টা বাজে। এক জায়গায় বসে কেমন ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিয়েছি।  ফোন বেজে চলেছে বেডরুম থেকে। উঠে গিয়ে ধরব, ইচ্ছে করছে না। শরীরে হু-হু করে মেদ বাড়ছে। নিয়মিত বাইরে খাওয়ার ফল। হিসেব করলে দেখা যাবে, প্রতি মাসে কয় বেলা ঘরের রান্না খাওয়া হয় তা হাতের কড়ে গুনে বের করতে পারব।

শ্লেষ্মাজড়ানো একটা কন্ঠে আমার নাম ধরে ডাকল কেউ। কোন একটা ঘরের ভিতর থেকেই। বাইরে থেকে ডাকলে বোঝা যেত।

“শিপন, তোর মোবাইলে রিং হয়। ফোন উঠাস না কেন?..”

যেন প্রশ্ন না। শ্লেষ্মা জড়ানো কণ্ঠটা নির্দেশ দিচ্ছে ফোন ওঠাবার। আজ যখন ফিরেছি, লক ছিল বাইরে থেকেই। চাবি ঘুরিয়ে খুলেছি খুব স্মরণ আছে। অন্ধকার আমার ভালো লাগে না তবু লীনা রুমগুলোর বাতি নিভিয়ে বের হয় সব সময়। আমি আবার সবকটা লাইট জ্বালিয়ে, ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ভরে এরপর ড্রয়িং রুমে বসেছিলাম। কেউ ভেতরে থাকলে টের পেতাম না?

“শিপন, কী হলো? তুই জানিস না ফোনের রিংটোন শুনলে আমার মাথা ব্যাথা করে?”
কে বলতো এই কথা? নানাভাই?     
ডিভান থেকে শরীরটা ওঠাতে খুব বেগ পেতে হলো। একসময় কলেজ টিমে দুর্দান্ত ফুটবল খেলা আমার এত বড় ভুঁড়ি হয়েছে ভাবা যায় না। মোটা লোকদের এত অপছন্দ করতাম। বলে বেড়াতাম মানুষ চাইলেই ফিট থাকতে পারে। এমনকি ফেসবুকে একবার বন্ধুদের থেকে অপিনিয়ন চেয়েছিলাম, “জাতি হিসেবে বাঙালি কি অলস?” আশিভাগ লোক ভোট দিয়েছিল অলসতার পক্ষে। মেনে নিয়েছিলাম, এই ভুখণ্ডের মানুষ অলস। বাস না পেলে মাইল মাইল হাঁটবে। বাস এভেলবল দেখলে আধা কিলোর জন্যও ভিড় ঠেলে উঠে পড়বে।

বেশ তো। দৃশ্যটা খুব অস্বাভাবিক লাগল না। একটা ধুতি আর স্যান্ডোগেঞ্জি গায়ে নানাভাই বসে আছেন বেডরুমের এক কোনায়। শৈশবে আমি ঈশ্বরের অবয়ব কল্পনা করতে চেষ্টা করতাম। দেখতাম যে একটা উঁচু আসনে বসে আছেন তিনি, প্রাচীন এক বৃক্ষের ছায়াতে, পরণে ধুতি আর পাতলা স্যান্ডোগেঞ্জি। নানাভাই পরতেন লুঙ্গি। এখন ধুতি কেন পরে আছেন কে জানে। চেহারায় ঝলমল করছে হাসি। আমাকে দেখে বললেন, “ফোন ধরিস না কেন রে গাধা?”

ফোন করেছে ত্রপা। নানাভাইয়ের হাসি হাসি মুখের সামনেই কলটা রিসিভ করলাম।
হ্যাঁ, ত্রপা, বল।
ফোনের ওপার থেকে অসহিষ্ণু কন্ঠে ছোটবোন বলল, “ভাইয়া ফোন ধরছিলি না কেন? কতক্ষণ ধরে ট্রাই করছি জানিস?”
অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত লাগছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কী হয়েছে?
পারিজাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবি আর আমি সুপারশপে গিয়েছিলাম সন্ধ্যায়। বাবু তো খুব পছন্দ করে ঘুরতে। কিডস কর্নারে ওকে রেখে আমরা কেনাকাটা করেছি। এসে দেখি নেই।
নেই মানে কী?
জানি না ভাইয়া। কী করব বুঝতে পারছি না। ভাবি খুব কান্নাকাটি করছে। আমরা কী করব এখন?

ত্রপা ফোনের ওপাশে কথা বলতে বলতে কাঁদতে শুরু করল। কী বলছে হড়বড় করে শুনতে পেলাম না। আমাদের মেয়ে হারিয়ে গেছে এর মানেটা কী? এই যুগে কারো বাচ্চা হারায়?
তোরা কোথায় এখন?
পল্লবী থানায়।
পুলিশ কী বলেছে?
আর কোনো জবাব পেলাম না। ও হয়তো ফোন কেটে দিয়েছে। পারিজার বয়স চার বছর। দৌড়ে বেড়ায়। চুপচাপ থাকা স্বভাব হলেও ভেঙে ভেঙে প্রায় ভালোই কথা বলতে পারে, বোঝে। অফিসের ড্রেস পরেই আমি বাইরে বেরুলাম। পল্লবী থানা যেতে দশ মিনিট লাগবে। রিকশায় বিশ টাকা নেয়। একটা রিকশা থামিয়ে উঠে পড়লাম। কী করব মাথায় আসছে না। বাচ্চারা হারিয়ে গেলে তাদের কিভাবে খুঁজে বের করে? মসজিদে নিখোঁজ সংবাদ দেব কি?

থানার সামনে রিকশা থেকে নেমেছি, দেখলাম গেটের সামনে ত্রপা আর লীনা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই ওরা ছুটে এলো। দুজনকেই বড় অসহায়, আশাহীন দেখাচ্ছে। টানা কেঁদেছে দুজনে, বোঝা চলে।

শিপন এখন কী করব আমরা? আমার পারিজাকে খুঁজে এনে দাও।
পুলিশ কী বলেছে?
জিডি নিয়েছে। বলেছে চব্বিশ ঘণ্টার আগে কিছু করতে পারবে না।  আজকের মধ্যে পাওয়া না গেলে কাল বিকেল থেকে ওরা তল্লাশি শুরু করবে। অতক্ষণে আমার পারিজা কোথায় থাকবে? ও আল্লাহ গো!

চোখের সামনে লীনা জ্ঞান হারাল। মাটিতে পড়ার আগে ওকে ধরে ফেললাম আমি। ত্রপা আবার উচ্চশব্দে কাঁদতে শুরু করেছে। ধমক দিতে ইচ্ছে হলেও সামলে নিলাম। একটা বাচ্চাকে নিয়ে বের হয়ে এতটা কেয়ারলেস কিভাবে হয় মানুষ? কয়েক মিনিটেই জ্ঞান ফিরল লীনার। আবার চারদিকে লোক জমে গিয়েছে। মানুষ পারেও। কারো কি কোনো কাজ নেই? একটা সিএনজিতে ওদের তুলে দিয়ে বললাম, “তোমরা বাসায় যাও। আমি দেখছি কী করা যায়।”
***
সুপার শপের দারোয়ান বলল, “বাচ্চাটারে আমি বাইর হইতে দেখছি। আর দুইজন মহিলার পিছে পিছে কেমন হেইলা দুইলা আগায়া গেল। আমি তো ভাবছি অরাই গার্জেন সার।”
আশ্চর্য। এত দিন ধরে এই দোকানে শপিং করি আমরা। একটু খেয়াল করবেন না?
এত এত লোক সার, কত খেয়াল রাখুম কন?

ওখান থেকে বেরিয়ে আশেপাশের প্রায় সব দোকানে অস্থির হয়ে খোঁজ করলাম। চার বছরের বাচ্চা। সবুজ হাতাকাটা ফ্রক পরা, ফর্সা রঙ, লালচে চুলে ছোট্ট দুই বেণি, কপালের বাম পাশে আধা ইঞ্চির মতো কাটা দাগ, পায়ে গোলাপি স্নিকার। অনিক প্লাজার সামনে অজস্র ফুডকোর্ট, খেলনার দোকানদাররা কেউ কিছু বলতে পারল না।

কত বাজে এখন?
ধীরে ধীরে বাসের সংখ্যা কমে যাচ্ছে রাস্তায়। দোকানপাট বন্ধ হতে শুরু করেছে। পথে যতগুলো মসজিদ পেয়েছি কিংবা ওয়ার্ড কমিশনারের বাসায়, কোথাও জানাতে বাকি রাখলাম না। কোনো বাচ্চা পেলে যেন সঙ্গে সঙ্গে এনাউন্স করা হয়। মিরপুর বড় ঘিঞ্জি এলাকা হয়ে গিয়েছে আজকাল। অতো ছোট মা’টা আমার এই ভিড়ের মাঝে কোথায় চলে গেল?

বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছেনা আর।
কোন মুখ নিয়ে ফিরব? তবু এক সময় ক্লান্তি এসে ভর করল। চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আষাঢ়ের রাত্রি, বাতাস ভেজা ভেজা। হয়তো বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষণ পর। লীনার বড়ভাই অনেকক্ষণ ধরেই ফোন করছে। আজব মানুষ। এতবার ফোন করার কী আছে? পর পর অনেকগুলো সিগারেট আর কয়েক কাপ চা ফুরিয়ে গেল, বেঞ্চে বসে আছি কতক্ষণ ধরে? চা’অলা বলল, “মামায় কি সিক?”  

নিজেদের বাসায় পা রাখলাম বহুদিন পর। কেন যে ছেড়েছিলাম এ বাসা, আজ আর হৃদয়ে তার কোনো অভিঘাত নেই। আমায় দেখে আম্মা-আব্বা ছুটে এলেন। ত্রপাও।

কোনো খোঁজ পেলি শিপন?
নাহ। কেউ দেখেনি। ওই এলাকার কোথাও বাদ রাখিনি খুঁজতে। মসজিদে কেউ দিয়ে গেলে মাইকিং করে জানাবে বলেছে। লীনা কোথায়?
আব্বা বললেন, পাগলামো করছিল খুব। ডাক্তার এসে সিডেটিভ দিয়ে গেছে। তুই যা ভিতরে। মেয়েটার তোকে দরকার এখন খুব। ঘুম ভাঙলে আবার কান্নাকাটি শুরু করবে। গোয়েন্দা বিভাগের সলিমুল্লাকে জানিয়েছি আমি। ওর টেরিটোরি তো এদিকেই। কালকের মধ্যে একটা না একটা সংবাদ পেয়ে যাব। টেনশন করিস না।

আমার রুমটার দরজায় আবার দেখলাম নানাভাইকে। সেই একই রকম হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন।

এই দুঃসময়েও আপনি হাসছেন নানাভাই?
হাসব না তো কাঁদব নাকিরে গর্ধব?
আপনি একটা অমানুষ।
হয়েছে। আর তুই খুব মানুষ।

নানাভাইকে পাশ কাটিয়েই ভিতরে ঢুকলাম। লীনা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আমার সেই পুরনো বিছানায়, বিয়ের প্রথম রাতটা যেখানে আমরা কাটিয়েছিলাম। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে ধীরে ধীরে, ঘুমাচ্ছে। দু’গালে, চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখা। নীলাভ ডিম লাইটের আলোতেও বোঝা চলে। পুরনো আমলের ইলেকট্রিক পাখাটা ঘোঁচ কোঁচ ঘোঁচ কোঁচ ধরনের শব্দ করছে। ছোটবেলায় কত খেলতাম এই শব্দের সঙ্গে। যান্ত্রিক ঘর্ষণের এ আওয়াজকে যেমন খুশি তেমন অর্থ করেই শোনা যেত। ট্রেনে চড়ার সময় যেটা করা যায়। ওর পাশে বসে রইলাম কিছুক্ষণ চুপচাপ। এমন মমতায় শেষ কবে ওর কপালে হাত রেখেছি মনে পড়ল না।

ঘুমালে বউ?
নাহ। ঘুম আসে না।
তুমি ঘুমাও পাখি। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
ভাঙা প্রাণহীন কন্ঠে লীনা বলল, “এভাবে না শিপন। আমাকে আদর করো।”

দূর থেকে দুয়েকটা নিশাচর গাড়ির শব্দ আসছে, খুব নিচু লয়ে বাতাসে ভাসছে খোল করতাল হারমোনিয়ামের ধ্বনি। উত্তরে এক ফুরোতে থাকা গ্রাম আছে তা জানি, মিলিটারি আবাসিকের পেছনে। সেখানে কি যাত্রাপালা চলছে রাতজাগা সব দুঃখী আত্মাদের নিয়ে? আশ্রয়ের সন্ধানে আমি লীনার বুকে আমার মুখটা ডুবিয়ে দিলাম। যে সঙ্গমে মরচে ধরেছিল আমাদের, আজ তা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাক।   

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;