বগুড়ায় বন্ধের পথে হিজড়াদের একমাত্র স্কুল
বগুড়ায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিজড়া সম্প্রদায়ের একমাত্র স্কুলটি অর্থের অভাবে বন্ধের পথে। সপ্তাহে দুইদিন করে হিজড়াদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় স্কুলটিতে। কিন্তু শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর জন্য নেই বইখাতা, কোনো শিক্ষা উপকরণ। এমনকি ওই স্কুলের কোনো নামও দেয়া হয়নি।
শিক্ষক হিসেবে যিনি আছেন তিনি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হলেও সম্মানী ভাতা পান না মাসের পর মাস। এ কারণে শিক্ষকের আগ্রহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থী উপস্থিতিও কমে যাচ্ছে দিন দিন।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে তৃতীয় লিঙ্গের নেত্রী সুমি হিজড়া তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বগুড়া শহরের কামারগাড়ি (হাড্ডি পট্টি) এলাকায় রেলওয়ের জায়গায় হিজড়াদের লেখাপড়ার জন্য স্কুল গড়ে তোলেন। সেখানেই হিজড়াদের অক্ষর জ্ঞান দেয়ার কাজ শুরু করেন সুমি হিজড়া নিজেই। কিন্তু অর্থের অভাবে সেই স্কুল বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। বন্ধ হয়ে যায় একসময়।
তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর হিজড়াদের নিয়ে কাজ শুরু করলে ২০১৮ সালে ওই স্কুলটি ফের চালু হয়। তখন শিক্ষার্থী উপস্থিতি এবং শিক্ষার আগ্রহ বাড়াতে তাদের উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসা হয়। এছাড়াও হিজড়াদের সংগঠন বলাকা মানব উন্নয়ন সংস্থাকে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকেই এই সংগঠনের মাধ্যমে সুদ মুক্ত ঋণ সহযোগিতা দিয়ে হিজড়াদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা করে আসছে সমাজসেবা অধিদপ্তর।
শহরের কামারগাড়ি এলাকায় একটি টিনের ছাপরা ঘরে চলে আসছে হিজড়াদের ওই স্কুলের কার্যক্রম। সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যার পর চলে স্কুলের কার্যক্রম।
শনিবার (১৯ জানুয়ারি) সন্ধ্যার পর সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের শিক্ষার্থীদের বসার বেঞ্চগুলো ফাঁকা পড়ে আছে। স্কুলে আসা মালা, শেফালী ও রত্না হিজড়া জানান, তারা এক বছর যাবৎ স্কুলে লেখাপড়া করলেও তাদের কোনো বই খাতা দেয়া হয়নি। হিজড়াদের মধ্যেই শিক্ষিত একজন তাদেরকে নাম-ঠিকানা লেখা শিখিয়েছে। এছাড়াও তাদেরকে অক্ষর জ্ঞান দেয়া হয়। বই খাতা পেলে বাসায় অবসর সময়ে আরও লেখাপড়া করতে পারবেন।
তারা বলেন, ‘এমনিতেই আমরা সমাজে অবহেলিত। আমাদেরকে কেউ কাজে নিতে চায় না, বাসা ভাড়া দিতে চায় না। পরিবারও আমাদেরকে বোঝা হিসেবে মনে করে।’
হিজড়াদের নেত্রী ও বলাকা মানব উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি সুমি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নিজের টাকায় রেলওয়ে থেকে জায়গা লিজ নিয়ে স্কুল ঘর তৈরি করেছি। সমাজসেবা থেকে বছরে একেক জনকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা করে উপবৃত্তি দেয়া হয়। এই টাকায় হিজড়ারা চলতে পারে না।’
তিনি জানান, সমাজে অবহেলিত হিজড়ারা কাজ চায়। কাজের পাশাপাশি শিক্ষা প্রয়োজন। আর এ কারণেই নিজ উদ্যোগে স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে। শুরুতে স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল ১৪৭ জন। এখন রয়েছে ৯১ জন। তাও আবার উপবৃত্তি দেয়ার কারণে তাদেরকে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু সরকারি বেসরকারি ভাবে কেউ স্কুলের উন্নয়নে কোনো সহযোগিতা করে না। ফলে স্কুলের কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে না। এখন এটি অর্থের অভাবে বন্ধের পথে।
হিজড়াদের স্কুলের শিক্ষক নাসিরুজ্জামান খান তপু নিজেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। লাইট হাউজ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় তিনি হিজড়াদের নিয়ে কাজ করেন। বার্তা২৪.কমকে খান তপু জানান, লাইট হাউজের হিসেব অনুযায়ী বগুড়া জেলায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছে ৭২৫ জন।
তিনি জানান, হিজড়াদের স্কুলে বই-খাতা, কলম এমনকি কোনো শিক্ষা উপকরণ দিয়ে কেউ সহযোগিতা করে না। তারপরেও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীরা এখন নিজের নাম ঠিকানা লিখতে পারে। বাংলার প্রত্যেকটি অক্ষর চিনতে পারে। এছাড়াও যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ দিয়ে ছোটখাট অংক করতে পারে।
বগুড়া শহরের সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম লিটন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নীতিমালার মধ্যে থেকে আমরা হিজড়াদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করে থাকি। তাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। তাদের সংগঠনকে নিবন্ধন ভুক্ত করে সুদ মুক্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে পর্যায়ক্রমে আরও উদ্যোগ নেয়া হবে।’