মৌলভীবাজারের নদী, খাল-বিল ও হাওরের বেহাল দশা
মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম নদী মনু, ধলাই, ফানাই, সোনাই ও জুড়ী এখন মূমূর্ষ অবস্থায়। অন্যদিকে মরে যাওয়া শাখা নদী বরাক, বিলাস, লাংলী, গোপলা ও আন ফানাই নদীর অস্তিত্বই বোঝার উপায় থাকে না শুষ্ক মৌসুমে। বর্ষা মৌসুমে পানির ধারণক্ষমতা না থাকায় নদী, গাঙ ও হাওরগুলোর তীর ভেঙে প্লাবিত হয় আশপাশের গ্রাম। পানিতে তলিয়ে ক্ষতি হয় মানুষের ঘরবাড়ি ও চাষাবাদের জমি।
উল্টো চিত্র শুষ্ক মৌসুমে। নদী, গাঙ ও হাওরের বিলগুলোতে পানি না থাকায় চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষিজীবী লোকজন।
নদী ও হাওর তীরবর্তী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মনু নদীর বিভিন্ন স্থানে শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে ওঠে। কুলাউড়ায় ফানাই, কমলগঞ্জে ধলাই, জুড়ী উপজেলা জুড়ী ও সোনাই নদীর একই অবস্থা।
মহাসংকটে কোনো রকম বেঁচে থাকা জেলার নদী, খাল, হাওর, জলাশয় ও গাঙয়ের চিরচেনা দৃশ্যে এখন অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। নানা সমস্যা ও সংকটে, নদীগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে।
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারহীনতায় এমন বেহাল দশা। কোনো স্থানে ভরাট হচ্ছে জেলার নদী, খাল, হাওর ও গাঙ। কিন্তু নেই কোনো সংস্কারের উদ্যোগ। বছরের পর বছর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতায় ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব টানপোড়নে, এখন শুধু মানচিত্রেই এসব নদী, গাঙ, ছড়া, খাল, জলাশয় ও হাওর। কিন্তু বাস্তব দৃশ্যে তার মিল নেই।
স্থানীয়দের শঙ্কা দূর্দশা চলমান থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই তা বিলীন হবে। তাদের আশংকা, প্রতিবছর পলি জমে ভরাট হচ্ছে- নদী, খাল, গাঙ, জলাশয়, জলাধার ও হাওরগুলো। আর এই সুযোগে চলে দখল উৎসবও।
জানা গেছে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের পাশে কুশিয়ারা নদীর একটি শাখা বরাক নাম ধারণ করে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শীতকালে বরাক একেবারে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট দিয়ে প্রবাহিত লাংলী নদী হেতিমগঞ্জ নামক স্থানে বিলাস নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে আসা এ নদীর রূপরেখা খালে পরিণত হয়েছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান, মঙ্গলের হাইল হাওরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গোপলা নদী তার ঐতিহ্য হারিয়েছে, পলির কারণে ভরাট হয়ে গেছে।
কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ের বাসিন্দারা জানান ফানাই ও আন ফানান একসময় খরস্রোতা থাকলেও এখন নানা কারনে ভরাট হয়ে যাওয়াতে নেই সেই জৌলুস।
সিন্দুরখান এলাকার বাসিন্দারা জানান লাংলী নদীর বিভিন্ন অংশ বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। স্থানীয়দের কাছে লাংলী নদী নয় এখন তা কালেঙ্গিছড়া হিসেবে পরিচিত। শীতকালে এসব নদীর বুকে চাষাবাদ হয় শাকসবজি, চড়ানো হয় গরু, মহিষ ও ছাগল।
অন্যদিকে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদীর অংশের তলদেশ পলি জমে ভরাট হওয়ায় দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও কাউয়াদীঘি সমান্তরাল। হাওর দু’টিও ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি নিষ্কাশন এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আর ফসলহানী হাওর দু’টির নিত্যসঙ্গী। একই অবস্থা হাইল হাওরেরও। তাই মৌসুমে আউশ, আমন, বোরো ও সবজি চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় স্থানীয় কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষিজীবীরা জানান, দীর্ঘদিন থেকে ভরাট হওয়া নদী, খাল, গাঙ, জলাশয়, জলাধার ও হাওরগুলোর পুনঃখনন না হওয়াতে বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে আগের মতো তারা চাষাবাদ করতে পারছেন না। শীতকালে আগে কৃষকরা সেচ সুবিধা পেতো। তখন কৃষিক্ষেত্রে এসেছিল অভাবনীয় সাফল্য। এই নদীগুলো দিয়ে একসময় বড় লঞ্চ, নৌকা চলাচল করত। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল এই নৌপথকে ঘিরে। অথচ এখন শুষ্ক মৌসুমে মানুষ পায়ে হেঁটে এই নদীগুলো পার হয়। এরই সাথে বড় সড়কগুলোর পাশে থাকা দেশীয় প্রজাতীর মাছের নিরাপদ অভয়াশ্রম এই জলাশয়গুলোও এখন নেই বললেই চলে।
মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি প্রবীণ রাজনীতিবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ. স. ম ছালেহ সুহেল বলেন দেশীয় প্রজাতির মাছসহ জলজপ্রাণি, উদ্ভিদ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভরাট হওয়া এ জেলার স্থানীয় খাল, জলাশয়, বিল, নদী, গাঙ ও হাওরগুলো পরিকল্পিতভাবে দ্রুত খনন প্রয়োজন। এগুলো পুনখনন হলে তখন অবৈধ দখল থাকবে না। বন্যা ও খরা থেকে জলজপ্রাণী, উদ্ভিদ, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও দূর্লভ প্রজাতির নানা জীববৈচিত্রও রক্ষা পাবে।