ডাকাতিয়ায় নদী দখল হয়, উদ্ধার হয় না
ভূমিদস্যুদের অবৈধ দখলের কবলে পড়ে ঐতিহ্য হারাচ্ছে প্রাচীনতম এবং ঐতিহ্যবাহী নদী ডাকাতিয়া। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা ছাড়াও অসংখ্য লোক কাহিনীতে পাওয়া যায় ডাকাতিয়ার নাম।
নদীটির উৎসস্থল ভারতের পার্বত্য ত্রিপুরার রঘুনন্দন পাহাড়ে। কুমিল্লা জেলার সোনাইমুড়ি সীমান্ত দিয়ে এ নদী প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে।
ডাকাতিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত নদী। নদীটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলা দিয়ে বয়ে গেছে। এর দৈর্ঘ্য ১৪১ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ ৬৭ মিটার। ডাকাতিয়া নদী মেঘনার একটি উপনদী।
নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা জেলার বাগসারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং পরবর্তীতে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর কুমিল্লা লাকসাম ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলা অতিক্রম করে চাঁদপুরের কাছে মেঘনা মিলিত হয়।
ডাকাতিয়া বর্ষাকালে ভারতের দিক থেকে বিপুলসংখ্যক পাহাড়ি প্রবাহকে গ্রহণ করে। আর বছরের বাকি সময়ে নদীটি মেঘনার জোয়ারের পানি গ্রহণ করে থাকে। এক সময় নদীটি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার কাছে মেঘনায় মিলিত হতো। বর্তমানে ডাকাতিয়া বিভক্ত দুই ধারায়। মূল ধারাটি রায়পুরে মেঘনায় মিশেছে। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে বড় ধারাটি পড়েছে চাঁদপুরের মেঘনায়।
এখন ডাকাতিয়া প্রভাবশালী দখলদারিত্বের কারণে মৃতপ্রায়। নদীতে নেই জোয়ার-ভাটার উত্তাল ঢেউ। অবৈধ দখল আর দূষণে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে ডাকাতিয়া। নদীকে ঘিরে এক সময় এর দুই পাশে গড়ে উঠে জেলে পল্লী। এ নদীতে মাছ ধরেই তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। ভূমিদস্যুদের দখলদারিত্বের কারণে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা ডাকাতিয়া। নদীতে নেই মাছ। তাই বাপ-দাদার ব্যবসা নদীতে মাছ ধরা বন্ধ করে দিয়েছেন অনেক জেলে। এসব জেলেদের দিন চলছে অনেক কষ্টে।
হাজীগঞ্জ উপজেলার জেলে কার্তিক দাস। তিনি জানান, ডাকাতিয়ায় আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। নদীও ছোট হয়ে গেছে। শীতকালে পানি নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমরা মাছ ধরা ছেড়ে দিয়েছে। বর্ষাকালে এ নদীতে আইড়, বাইলা, ট্যাংকার, পুঁটি ও নদীর চরগুলোতে চিংড়ি মাছ পাওয়া যায় যত সামান্য।
ডাকাতিয়া নদীতে চাঁদপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ৫নং ঘাট, ৩নং ঘাট, ১০নং ঘাট, চৌধুরী ঘাট ও নতুন বাজার এলাকার নদীর দুই পাড়ে শত শত পাকা বিল্ডিং ও আধাপাকা টিনসেড ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর নির্মাণ করে ডাকাতিয়া পাড় দখল করায় শহরে পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব স্থাপনা কয়েকবার উচ্ছেদ করা হলেও দখলমুক্ত হয়নি। উচ্ছেদের পরবর্তী সময়ে আবারও দখল করে নিচ্ছে ভূমিদস্যুরা।
নদী রক্ষায় বিভিন্ন সময় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্টরা নানা প্রতিশ্রুতি শোনালেও এখন পর্যন্ত কার্যত কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। তবে চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি এলাকার প্রায় ৪০ নটিক্যাল মাইল ড্রেজিং করার কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন।
ডাকাতিয়া নদীর মেঘনার প্রবেশ মুখের চাঁদপুর পুরান বাজার ও নতুন বাজারসহ বেশিরভাগ এলাকায় নদীই দখল হয়ে নদী সরু হয়ে গেছে। এছাড়াও জেলাসহ ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি উপজেলায় নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ বালুমহল। এসব বালু মহলে বালু দিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে ডাকাতিয়া। এতে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী। অন্যদিকে দখলের কারণে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ আটকে যাওয়ায় ফসল উৎপাদনও ব্যহত হচ্ছে।
আলীগঞ্জ, শাহরাস্তি, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, জগন্নাথপুর সহ বিভিন্ন স্থানে নদীর পাল দখল করে অবৈধ বালু ব্যবসার কারণে ভরাট হয়ে যাচ্ছে প্রমত্তা ডাকাতিয়া। বালু ব্যবসায়ীরা বালু ফেলে নদীর নাব্যতা কমিয়ে আনছে। ফলে ফলে ধীরে ধীরে নদীর মধ্যে জেগে উঠছে চর। একসময় ওইসব বালু ব্যবসায়ীরা এ জমি নিজেদের বলে বিক্রয় করে দিচ্ছেন।
প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ডাকাতিয়া নদীটির বেশিরভাগ জায়গা দখল করে আছে কচুরিপানা। ফরিদগঞ্জ পৌর সদর বাজারের সব বর্জ্য কেরোয়া ব্রীজসংলগ্ন জায়গায় নদীতে ফেলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়াও হাজীগঞ্জ বাজারের মুরগির ব্যবসায়ীদের মুরগি ড্রেসিং করার পর যে ময়লা আবর্জনাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়ির পয়ঃনিষ্কাষণের বর্জ্য এবং পৌর কসাইখানার বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। এতে নদীর পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।