ঐতিহ্য হারাচ্ছে পোড়াদহের মেলা
ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বগুড়া তথা অত্র অঞ্চলের ঐতিহাসিক পোড়াদহের মেলা। বড় বড় মাছের সমারোহে গড়ে ওঠা এই মেলায় নেই আগের মতো বড় মাছ। তার পরও বুধবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকালে শুরু এবারে মেলার প্রধান আর্কষণ ছিল ৮২ কেজি ওজনের বাঘাইড় মাছ। এই মাছে দাম হাঁকা হয় প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকা।
নামে মাছের মেলা হলেও সংসারের যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপকরণ, কাঠের আসবাবপত্র, রকমারি মিষ্টি, বিনোদনের জন্য সার্কাস, নাগরদোলা, মোটরসাইকেল খেলা ও জাদু খেলা। মেলার সবকিছু ছাপিয়ে যায় যখন লক্ষ মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়।
মেলা উপলক্ষে আশে পাশের গ্রামগুলোতে সপ্তাহব্যাপী চলে উৎসবের আমেজ। আত্মীয় স্বজন ছাড়াও মেয়ে জামাইকে দাওয়াত করে বাড়িতে নিয়ে আসা বাধ্যতামূলক।
প্রতি বছরের শীতের শেষে মাঘ মাসের শেষ তিনদিনের মধ্যে বুধবার অথবা ফাল্গুন মাসের প্রথম বুধবার অনুষ্ঠিত হয় পোড়াদহের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। এর প্রথম দিন বুধবার মাছের মেলা আর পরদিন বৃহস্পতিবার বসে বৌ-মেলা। এদিন কেবল বিভিন্ন গ্রামের নববধূরা এবং স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসা কন্যারা তাদের স্বামীদের সঙ্গে মেলায় আসেন।
তবে পোড়াদহের মেলার অন্যতম আকর্ষণ বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় মাছ। বিশেষ করে নদীর বড় বড় বাঘাইড়, আইড়, বোয়াল, কাতলা, রুই, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, পাঙ্গাসসহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেচা-কেনা হয়। তবে এখন নদীতে তেমন মাছ না পাওয়ার কারণে পুকুরে চাষ করা বিভিন্ন ছোট বড় আকারের মাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়।
মেলা চলাকালে একসঙ্গে প্রচুর বড় ও জীবিত মাছ পাওয়া যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে জানা যায় অত্র এলাকার অনেক মৎস্যচাষি মেলায় অধিক লাভে বড় মাছ বিক্রির জন্য মাছ বড় করেন। মেলায় বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে ট্রাক যোগে মাছ নিয়ে আসা হয়। এছাড়া কাঠের আসবাবপত্র, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, লৌহজাত দ্রব্যাদি, ফলমূল, নানা ধরণের মিষ্টি ও মিষ্টিজাত দ্রব্য এবং প্রচুর চুন মেলায় পাওয়া যায়। কৃষকেরা প্রয়োজনীয় ঘরোয়া সামগ্রী ছাড়াও সারা বছরের পান খাওয়ার চুন পর্যন্ত মেলা থেকে সংগ্রহ করে থাকেন।
মেলা শুরুর সঠিক দিনক্ষণ জানা না গেলেও কথিত আছে, প্রায় ৪০০ বছর আগে গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের গোলাবাড়ি বাজারের অদূরে পোড়াদহ সংলগ্ন মরা বাঙালি (মতান্তরে মহিষাবান নদী) নদীতে মাঘের শেষ বুধবারে অলৌকিকভাবে বড় একটি কাতলা মাছ (মতান্তরে অজ্ঞাত মাছ) সোনার চালুনি পিঠে নিয়ে ভেসে ওঠে। মাঘের শেষ বুধবারের এ অলৌকিক ঘটনা দেখার জন্য প্রচুর লোকজন জড়ো হয়। পরে স্থানীয় একজন সন্ন্যাসী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে অলৌকিক এ মাছের উদ্দেশ্যে পূজা করার জন্য সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেন। সন্ন্যাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পোড়াদহ বটতলায় মাঘের শেষ বুধবারে অলৌকিক মাছের উদ্দেশ্যে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পুজা শুরু করেন।
তবে মহিষাবান সার্বজনীন সন্যাসী পূজা ও পোড়াদহ মেলা উদযাপন কমিটির সসভাপতি নিকুঞ্জ কুমার পাল বার্তা ২৪.ডটকমকে বলেন, ‘গাড়িদহ (মরা বাঙালি) নদী সংলগ্ন বিশাল দহ ছিল। সেখানে বিশাল আকৃতির একটি বট গাছের নিচে সাধু সন্যাসীদের আনাগোনা ছিল। কালের বিবর্তনে দহ মাটি ভরাট (পুরাট) হয়ে গেলে নাম হয় পোড়াদহ। বট গাছের নিচে সন্যাসীরা মহাদেবের পূজা করত। সেই থেকে সন্যাসীদের পূজার দিন মেলার প্রথা চালু হয়।’
তিনি বলেন, ‘বর্তামানে জায়গা নিয়ে জটিলতা ও মেলা উদযাপন কমিটির সমন্বয় হীনতার কারণে মেলার ঐতিহ্য দিন দিন হারাতে বসছে। আর এসব কারণে এবার মেলায় সন্যাসী পূজার স্থলে না হয়ে আধা কিলোমিটার দূরে ইট ভাটার মাঠে আয়োজন করা হয়েছে।’
গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার মেলায় লোক সমাগম কমে গেছে। পোড়াদহ মেলার আশে পাশে জোরগাছা, পাঁচমাইল, সাবগ্রাম, অদ্দিরগোলা, দাড়াইল এলাকায় মাছের মেলার আয়োজন করা হয়েছে। ফলে অনেকেই পোড়াদহের মেলায় না গিয়ে আশে পাশের মেলা থেকে মাছ কিনে বাড়ি ফিরছেন।
রানীর পাড়া গ্রামের বরকত উল্লাহ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘মেলায় মাছের দাম অনেক বেশি। চার কেজি ওজনের কাতল মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৪৫০টাকা কেজি। সিলভার কার্প মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি। বাঘাইড় ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা কেজি। রুই মাছ ৪০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা কেজি।
মেলার বাইরে পাঁচমাইল বাজারে মাছ কিনতে আসা আবুল কালাম বলেন, ‘মেলা আগের মতো আর নাই। মেলার ঐতিহ্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বাইরে থেকে মাছ কিনলাম।’
পোড়াদহ মেলা কমিটি সভাপতি মহিষাবান ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘মূলত এ মেলার নাম ছিল সন্যাসী মেলা। কিন্তু স্থানের নাম পোড়াদহ হওয়ায় মেলাটি পোড়াদহ মেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।’