সুবীর নন্দীর বেদখল পৈতৃক ভিটায় সংগীত চর্চা কেন্দ্র চান স্থানীয়রা
সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। তার শেষ ইচ্ছা ছিল মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্য যেন জন্মভূমি হবিগঞ্জের মাটিতে করা হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে, সুবীর নন্দীর পৈতৃক ভিটা বেদখল হওয়ায় তার শেষকৃত্য হবিগঞ্জে করা হয়নি। ঢাকার সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে। যদিও পরিবারের পক্ষ থেকে এর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি।
জানা গেছে, হবিগঞ্জে পৈতৃক ভিটা উদ্ধার করে সেখানে একটি পাঠাগার ও সংগীত চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন এই সংগীত শিল্পী। এ ব্যাপারে তিনি হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনাও করেছিলেন। জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবির মুরাদও তাকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
জানা গেছে, হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার নন্দী পাড়া গ্রামের কৃতি সন্তান সুবীর নন্দী। তার উত্তরসূরিরা ছিলেন জমিদার পরিবারের। নিজেদের বংশের নামে (নন্দী) গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘নন্দী পাড়া’। বানিয়াচংয়ের হাওরজুড়ে তাদের ছিল বিশাল সম্পত্তি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বসবাস না করায় পৈতৃক ভিটা ও হাওরের জমি দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
গত ৯ মে বানিয়াচং উপজেলার ‘নন্দী পাড়া’ গ্রামে সুবীর নন্দীর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে গেছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে অনেক স্থাপনাও। শুধুমাত্র একটি ভবন এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে মল ত্যাগ করে রেখেছে এলাকার বখাটেরা। অভিযোগ আছে, রাতে নেশার আড্ডাও বসে সেখানে।
এলাকাবাসী জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের অত্যাচারে বসত ভিটা ছেড়ে স্ব-পরিবারে ভারতে চলে যান সুবীর নন্দীর উত্তরসূরিরা। স্বাধীনতার পর দেশে আসলেও তারা আর নন্দীপাড়া যাননি। সুবীর নন্দীর পিতার চাকরির সুবাধে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানেই বসবাস করতেন তাদের পরিবার। পরবর্তীতে হবিগঞ্জ শহরের বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন তারা। সেখান থেকেই সুবীর নন্দীর বেড়ে উঠা।
লেখাপড়া করেছেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারি বৃন্দাবন কলেজে। আর সংগীত চর্চা মূলত মার কাছে। তবে হবিগঞ্জ সুর বিতানে ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষা। পরবর্তীতে হবিগঞ্জ ছেড়ে চলে যান ঢাকায়। এরপর আর ফেরা হয়নি হবিগঞ্জে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবার পরিজন নিয়ে হবিগঞ্জ ঘুরতে আসতেন তারা।
এদিকে, দীর্ঘদিন বিশাল সম্পত্তি পড়ে থাকায় একটু একটু করে বেদখল হওয়া শুরু হয়। হাওরের ফসলি জমি দখল করে নিয়েছে এলাকার প্রভাবশালীরা। আর বসত ভিটাটি দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত থাকায় অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে দখলে নেয় সরকার। সেখানে সরকার উপজেলা ভূমি অফিস নির্মাণ করেছে। এছাড়া সেখানে থাকা একটি বসতঘর এখনও পরিত্যক্ত রয়েছে। আর বাকি স্থাপনাগুলো ভেঙে দিয়েছে সরকার। কিছু কিছু স্থাপনায় বসানো হয়েছে সরকারি কোয়ার্টার।
যদিও দীর্ঘদিন ধরে পৈতৃক ভিটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন সুবীর নন্দী। সর্বশেষ হবিগঞ্জ জালাল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত লোকজ সাংস্কৃতিক উৎসবে এসে জেলা প্রশাসকের কাছে মৌখিক আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ সময় জেলা প্রশাসক তাকে পৈতৃক ভিটা উদ্ধারের আশ্বাস দেন।
এ ব্যাপারে নন্দী পাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও সরকারি চাকরিজীবী হাফিজ মিয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘ওনার (সুবীর নন্দী) পৈতৃক ভিটা বেদখল হয়ে গেছে। আমরা সরকারের কাছে এখানে একটি ‘সুবীর নন্দী সংস্কৃতি অডিটরিয়াম’ ও ‘সংগীত চর্চা কেন্দ্র’ গড়ে তোলার দাবি জানাই। যাতে আগামী প্রজন্ম এখান থেকে সংগীত চর্চা করতে পারে।’
স্থানীয় বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস শহীদ বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘সুবীর নন্দী ছিলেন বানিয়াচংসহ সারাদেশের গর্ব। অথচ তার পৈতৃক ভিটা বেদখল হয়ে গেছে। সরকার এটা সংরক্ষণ করলে এলাকাটি দর্শনীয় স্থান হতে পারে।’
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী হবিগঞ্জ জেলা সংসদের সহ-সভাপতি এমদাদুল হোসেন খান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘সুবীর নন্দী একজন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তার পৈতৃক ভিটা সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের। আমাদের বানিয়াচংবাসীর প্রাণের দাবি তার (সুবীর নন্দী) পৈতৃক ভিটাটি সংরক্ষণ করে এখানে একটি ‘সুবীর নন্দী সাংস্কৃতি অডিটোরিয়াম’ ও ‘সুবীর নন্দী সংগীত চর্চা কেন্দ্র’ গড়ে তোলা হোক।’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবির মুরাদ বার্ত২৪.কম-কে বলেন, ‘সুবীর নন্দী শুধু হবিগঞ্জের নয়, দেশের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তার সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমরা তার স্মৃতি সংরক্ষণে তার পৈতৃক ভিটায় একটি গণগ্রন্থাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি।’