হবিগঞ্জে দু’শতাধিক ইটভাটায় পুড়ছে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য
হবিগঞ্জে লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ইটভাটা। অথচ কোনো ধরনের সরকারি নিয়ম-নীতি তোয়াক্কাই করছে না ইটভাটাগুলো। ইটভাটা আইনের সব ধারার বিপরীতে অবস্থান নিয়েই চালিয়ে যাচ্ছেন তদের কার্যক্রম। ফলে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি জমি ও জীববৈচিত্র্য তেমনি অন্যদিকে নষ্ট হচ্ছ পরিবেশ। পরিবেশবাদীরা বলছেন আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় ইটভাটার মালিকরা পরিবেশের উপর এমন অবিচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত আইন অনুযায়ী ইটভাটা স্থাপনের জন্য কেবল অকৃষি জমি ব্যবহার করা যাবে। আর ইট পোড়ানোর নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮৯ এর ৯(৫) অনুযায়ী কোনো ইটভাটাকে লাইসেন্স পেতে হলে উপজেলা সদরের সীমানা থেকে ৩ কিলোমিটার, সংরক্ষিত ও রক্ষিত বনাঞ্চল হতে ৩ কিলোমিটার এবং আবাসিক এলাকা (৫০ পরিবারের অধিক) অথবা ফলজ বাগান (৫০টি ফলজ বা বনজ গাছ আছে) থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে।
এছাড়া, নদীর পাড়ে কোনো ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না, ইটভাটার কাঁচামাল আনা-নেয়ার জন্য কোনো গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এই নিয়ম-নীতির একটিও অনুসরণ করছেন না ভাটা মালিকরা। যার যার ইচ্ছে মতোই চালিয়ে যাচ্ছেন ভাটার কার্যক্রম।
অনুসন্ধানে জানা যায়- হবিগঞ্জ জেলার সবকয়টি উপজেলায় যে সকল ইটভাটা গড়ে উঠেছে অধিকাংশই উপজেলা সদরের ৩ কিলোমিটারের ভেতরে। এছাড়া জনবসতিপূর্ণ (আবাসিক) এলাকা, স্কুলের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে সব কয়টি ইটভাটা। অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টো আবাসিক এলাকাসহ স্কুল-কলেজের পাশে নতুন করে ইটভাটার লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার বাহুবল ও চুনারুঘাট উপজেলায় রয়েছে শতাধিক ইটভাটা। আর বাকি ৬ উপজেলা মিলে রয়েছে আরও প্রায় শতাধিক। এরমধ্যে বাহুবল উপজেলার মিরপুর-ধুলিয়াখাল সড়ক, মিরপুর-বাহুবল সড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্তাগঞ্জ থেকে মিরপুর অংশে, মিরপুর-শায়েস্তাগঞ্জ সড়ক ও শায়েস্তাগঞ্জ-চুনারুঘাট সড়কের দু’পাশে সারি সারি ইটভাটা বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে।
ইটভাটার কাঁচামালসহ যাবতীয় জিনিসপত্র আনা-নেয়ার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা। ফলে প্রতিনিয়ত মালবাহী ট্রাক-ট্রাক্টর চলাচলের কারণে অল্প দিনেই ভেঙে পড়ছে রাস্তা-ঘাট।
শুধু তাই নয়, ফসলি জমি, নদী-ছড়া ও পাহাড় কেটে আনা হচ্ছে ইটভাটার মাটি। কয়লার বদলে পোড়ানো হচ্ছে বন, কাটা হচ্ছে গাছ।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ফসলের জমি থেকে মাটি ব্যবহার করায় জমি উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ইটের ধোঁয়ায় আম কাঁঠালসহ সব ধরনের ফলের উৎপাদনও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র। সেই সঙ্গে মানুষের দেহে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন রোগ-বালাই।
অভিযোগ রয়েছে- ইটভাটা পরিচালনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের চোখ-কান বন্ধ রাখার জন্য দেয়া হয় মোটা অংকের সেলামি। তাই প্রশাসনও না দেখার ভান করে বসে আছেন মহাসুখে। তবে মাঝে মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়। কিন্তু কঠোর কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় পুনরায় মালিক পক্ষ শুরু করেন তাদের এই অনিয়মের ব্যবসা।
এ ব্যাপারে বাহুবল উপজেলার চন্ডিছড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. রুহেল মিয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেন- ‘হবিগঞ্জ-মিরপুর সড়কের এক কিলোমিটার জায়গায় অন্তত ২০টি ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। এসব ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পরিবেশও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। অথচ সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।’
একই উপজেলার নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা সরাজ মিয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেন- ‘এখানে এতগুলো ইটভাটা কি বলব! সামান্য বাতাস দিলে সব ধুলাবালি গ্রামে গিয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ গ্রাম ধুলাবালিতে অন্ধকার হয়ে যায়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘কোন ইটভাটাই সরকারি নিয়ন নীতি অনুসরণ করছে না। ফলে এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় আমরা নিয়মিত আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু প্রশাসন আমাদেরকে তেমনভাবে সহযোগিতা না করায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন- ‘প্রতিবছর নিয়ম-নীতিহীনভাবে ইটভাটা স্থাপনের ফলে কৃষি ও পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। গেল কয়েক বছরে যত ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে এরজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ইটভাটা। এছাড়া অধিকাংশ ভাটায় ইট পোড়ানোর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনের মূল্যবান কাঠ। এতে নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র।’
হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল কবির মুরাদ বার্তা২৪.কম-কে জানান, ‘নিয়মিত ইটভাটায় অভিযান চালানো হচ্ছে। যার ধারা অব্যাহত রয়েছে এবং আগামীতেও থাকবে।’