ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস

দেড় শতাধিক বছর পরও অধিকার বঞ্চিত যারা

  • কাজল সরকার, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, হবিগঞ্জ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

হবিগঞ্জে বাস করা সাঁওতালরা, ছবি: বার্তা২৪

হবিগঞ্জে বাস করা সাঁওতালরা, ছবি: বার্তা২৪

ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস রোববার (৩০ জুন)। অধিকার আদায় করতে ১৮৫৫ সালের এই দিনে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন।তবে প্রায় দেড় বছর লড়াই করেও পেরে ওঠেনি ক্ষুদ্র এই নৃগোষ্ঠী।

সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৪ বছর পূর্ণ হলো। প্রতি বছরই হবিগঞ্জের চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলায় যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

গভীর বন-জঙ্গল কেটে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা জমিতে এখন তারা পরবাসীর মতো জীবন-যাপন করছেন। শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন চা বাগানে। অথচ এক সময় চা বাগানের গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন তারাই। আজ তার মালিক অন্য কেউ, তারা কেবলই শ্রমিক।

Santal

বিজ্ঞাপন

তবে স্বপ্ন আজও দেখেন তারা- যে অধিকার আদায়ের জন্য তাদের পূর্বপুরুষরা রক্ত দিয়েছিলেন, সেই অধিকার একদিন আদায় হবেই।

সাঁওতাল বিদ্রোহ যেভাবে হয়

ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ। গভীর বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে জায়গাটি বাসযোগ্য করে গড়ে তোলেন তারা। পরে সেখানে ধান, ভুট্টা, সবজিসহ সোনালি বিভিন্ন ফসল আবাদ শুরু করেন। ধীরে ধীরে সুখের রাজ্য হয়ে উঠেছিল দামিন-ই কোহ।

কিন্তু হঠাৎই সেখানে কুনজর পড়ে জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ী শোষক শ্রেণির। দলে দলে আসতে শুরু করে সাঁওতাল পরগনায়। সহজ সরল সাঁওতালদের ভুল বুঝিয়ে নিয়ে যেতে থাকে তাদের উৎপাদিত শস্য। এক সময় কৃতদাসের মতো খাটানো শুরু হয় সাঁওতালদের। বিনিময়ে সাঁওতালদের দেওয়া হতো সামান্য চাল, ডাল, লবণ, অর্থ আর তামাক। এই শোষণের মদদ দিতো ব্রিটিশরা। এক পর্যায়ে সাঁওতালরা শোষণের বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রতিবাদ শুরু করে।

Santal

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের চার ভাই সিধুঁ, কানহু, চান্দ ও ভাইরো জমিদার, ব্যবসায়ী ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাদের নেতৃত্বে যোগ দেন পুরো সাঁওতাল সম্প্রদায়। সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেন। অন্যদিক শোষকদের হাতে ছিল বন্দুক। ফলে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না সাঁওতাল সম্প্রদায়। তবুও থেমে থাকেনি, থেমে থেমে লড়াই চালিয়ে গেছেন।

এ সময় নেতৃত্বদানকারী চার ভাই যুদ্ধে শহীদ হন। এর মধ্য দিয়ে ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে এই বিদ্রোহ শেষ হয়। পরাজয় বরণ করতে হয় সাঁওতালদের। এ যুদ্ধে ইংরেজ সেনাসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল শহীদ হয়েছিলেন।

কেমন আছেন সাঁওতালরা

ভারতের বিভিন্ন স্থানসসহ বাংলাদেশের বেশ কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বাস করেন সাঁওতালরা। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মাধবপুর ও বাহুবল উপজেলার চা বাগানগুলোতে তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বসবাস। তিন উপজেলায় অন্তত ২০ হাজার সাঁওতাল থাকেন। ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের চেতনাকে এখনও তারা হৃদয়ে লালন করেন।নানা আয়োজনে প্রতি বছরই দিনটি পালন করেন তারা।

তারা এখনও তারা নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন চা শিল্পকে। এই চা আজ জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চললেও সাঁওতালদের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলায় যেন এতটুকুও। আজও তারা মাত্র ১২০ টাকা দৈনিক মজুরিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। নুন আনতে পান্তা ফুরালেও তাদের দিকে তাকানোর সময় নেই যেন কারোরই।

Santal

শিক্ষা-চিকিৎসা বঞ্চিত সাঁওতাল সম্প্রদায় এখনও যেন আধুনিক দাসই রয়ে গেছেন। নিজ দেশে অনেকটা পরবাসীর মতো জীবন-যাপন করছেন তারা। জীবনের দৈন্যদশায় তাদের বেঁচে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগেরই সম্ভব হচ্ছে না সন্তানদের লেখাপড়া করানো।

চানপুর চা বাগানের শ্রমিক মনমোহন সাঁওতাল বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা অধিকার আদায়ের জন্য জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও আমরা সেই অধিকার পাইনি। মাত্র ১২০ টাকা মজুরিতে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে আমাদের। যে জমিকে বাসযাগ্য করে তুলেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা, সেই জমিতে আজ আমাদের অধিকার নাই!

চন্ডিছড়া চা বাগানে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী অরুণ সাঁওতাল বলেন, অনেক বেশি লেখাপড়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মনে হয় পারব না। কাছে কোনো কলেজ নেই। অনেক দূর গিয়ে কলেজে ক্লাস করতে হয়। প্রতিদিন অনেক টাকা গাড়িভাড়া লাগে। যা আমার চা শ্রমিক মা-বাবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।

Santal

বাংলাদেশ আদীবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা চা বাগান শ্রমিক সমিতির সভাপতি স্বপন সাঁওতাল বলেন, ‘সাঁওতালরাই এই উপমহাদেশে পতিত জমি ও জঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষির উৎপত্তি ঘটিয়েছিল। ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছে এই সম্প্রদায়ই। কিন্তু সেই সাঁওতালরাই আজ অবহেলিত। ১৬৪ বছরেও আদায় হয়নি তাদের অধিকার।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ছেলে-মেয়েদের ঠিকভাবে দু’বেলা খাবার দিতে পারি না। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে পারি না। আর লেখাপড়া করানোর কথাতো চিন্তাই করা সম্ভব হয় না। তবু অনেক সাঁওতাল ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করছে। কিন্তু তারা সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না।’