ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষ: বিয়ে হলো ওদের, স্বপ্ন পুরণ হলো না
![ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত বর রাজন শেখ ও কনে সুমাইয়া](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2019/Jul/16/1563290734355.jpg)
ট্রেন-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে নিহত বর রাজন শেখ ও কনে সুমাইয়া
একমাত্র ছেলেকে বিয়ে দিয়ে নববধু ঘরে আনবেন। বছর ঘুরে নাতি-নাতনির মুখ দেখবেন। বাকী জীবন হেসে খেলে কাটিয়ে দিবেন। এমন স্বপ্ন নিয়েই সিরাজগঞ্জ শহরের কান্দাপাড়া গ্রামের আলতাফ হোসেন ও ঝর্না বেগম নিজেদের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন। কিন্তু, বিয়ে পড়ানোর এক ঘণ্টা পরেই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ছেলে আর নববধুকে লাশ হতে হলো।
সোমবার উল্লাপাড়ায় ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১১ জন নিহত হয়েছেন। এই মৃত্যুর মিছিলে বর রাজন শেখ ও কনে সুমাইয়াও ছিলেন। ছেলে ও নববধুকে হারিয়ে শোকে মূহ্যমান আলতাফ হোসেন ও ঝর্না বেগম দম্পতি। শুধু ছেলে আর নববধু নয়, এই দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে তাদের আরও ৯ স্বজনের।
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) নিহত রাজনদের বাড়িতে গেলে কান্না আর আহাজারি শব্দ কানে আসে। একদিন আগে যে বাড়ি গান বাজনার শব্দ আর হুই হুল্লোড়ে মেতে ছিলো আজ সেই বাড়ি শোকে নিস্তব্ধ। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে রাজন শেখের বাবা-মা পাগল প্রায়। কিছুতেই এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তারা। থেকে থেকে ডুকরে কেঁদে উঠছেন।
শোকের বাড়িটি ঘিরে প্রতিবেশি ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে আসা শত শত মানুষের ভিড়। কারো মুখে শান্তনা দেয়ার ভাষা নেই। সবার চোখের কোনে চিকচিক করছে জল।
প্রতিবেশীরা জানান, আলতাফ হোসেন একজন গরুর ব্যবসায়ী। তার ছেলে রাজন টুইস্টিং মিলের শ্রমিক। বড় মেয়ে স্বর্ণা খাতুনের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে রুপা লেখাপড়া করছে। বাপ-বেটা মিলে সংসারটা ভালোই চালাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই ঘটে গেলো এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।
নিহত রাজনের বোন রুপা জানান, এক সপ্তাহ আগে উল্লাপাড়া পৌর শহরের এনায়েতপুর গুচ্ছ গ্রামের মৃত গফুর শেখের মেয়ে সুমাইয়া খাতুনের (২১) সঙ্গে ভাইয়ের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়। ভাই ও আত্মীয়-স্বজন মিলে দুটো মাইক্রোবাস নিয়ে কনের বাড়িতে যাই। বর-কনে কবুল পাঠ করে একে অপরকে জীবনসঙ্গী (স্বামী-স্ত্রী) হিসেবে গ্রহণ করেন। পৌনে ৭ টার দিকে বাড়িতে ফোন দিয়ে বলে দেয়া হয় নববধু নিয়ে রওনা দেয়া হয়েছে। আমরা রাজন ও সুমাইয়ার জন্য বাসরঘর সাজিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু, ভাই-ভাবির সেই স্বপ্ন পূরণ হলো না…।
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন রুপা। আর কোনো কথা বলতে পারলেন না ভাই হারানো এ বোন। ভাই-ভাবি ও ৯ জন স্বজন হারিয়ে তাদের কাছে গোটা পৃথিবী যেন ভেঙে পড়েছে। কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না এ দুর্ঘটনা।
এদিকে মঙ্গলবার সকালে নিহতের স্বজনদের কোন অভিযোগ না থাকায় সকালে জিআরপি পুলিশ মরদেহগুলো পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন। সকাল ১১টার থেকে দুপুর (বাদযোহর) পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ পৌর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ, রামগাঁতি, কালিয়া হরিপুর, সয়াধানগড়া, দিয়ার ধানগড়া ঈদগাহ ও এনায়েতপুর গুচ্ছগ্রামের ঘাটিনা ঈদগাহ মাঠ ও রায়গঞ্জের উপজেলার কৃষ্ণদিয়ার গ্রামে পৃথকপৃথকভাবে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
এ দুর্ঘটনায় আরও যারা প্রাণ হারান, রাজনের মামা শামীম হোসেনের একমাত্র ছেলে বায়েজিদ ওরফে আলিফ (৯), রাজনের দুসম্পর্কের দাদা কাজিপুরা গ্রামের ভাষান শেখ (৫০), তার ফুপুর শ্বশুর সদর উপজেলার রামগাঁতী গ্রামের আব্দুস সামাদ (৪৫), সামাদের ছেলে শফিউল ওরফে শাকিল (১৯), ধর্ম বোনের স্বামী সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার দিয়ার ধানগড়া মহল্লার আলতাফ হোসেনের ছেলে শরিফ হোসেন (৩২), চাচাতো ভগ্নিপতি রায়গঞ্জ উপজেলার কৃষ্ণদিয়ার গ্রামের আলম মিয়ার ছেলে খোকন (২৪)।
এছাড়াও গুরুতর আহত হয়েছেন রাজনের আপন ছোট বোন স্বর্ণা খাতুনের স্বামী সুমন (৩০)। নিহত বাকিরা হলেন, মাইক্রোবাস চালক নুর আলম স্বাধীন (৫৫) ও তার সহকারি আহাদ আলী (৪৫)।