ধ্বংসের পথে মোগল আমলের মসজিদ
রংপুরে পীরগাছা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামটি ছিল ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহীদের শক্তিশালী গোপন ঘাঁটি। এই গ্রামেই নির্মিত মসজিদের পাশে ইংরেজদের আক্রমণে নিহত হন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক ‘দেবী চৌধুরাণী’ উপন্যাসের নায়িকা দেবী চৌধুরাণী (প্রফুল্ল)। এই কাহিনী অবলম্বনে কলকাতায় নির্মাণ করা হয়েছে ধারাবাহিক (সিরিয়াল) নাটক, যা বর্তমানে স্টার জলসায় দেখানো হচ্ছে।
জানা গেছে, চন্ডিপুরেই মোগল আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল একটি ছোট্ট তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মসজিদটি ধ্বংসের মুখে আছে। কারণ দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, দেয়ালে গজিয়ে উঠেছে গাছপালা ও লতাগুল্ম এবং গম্বুজে ফাটল ধরেছে। ইতোমধ্যে চারপাশের চারটি মিনার ধসে পড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মসজিদের ভেতর প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি দরজা। উত্তর ও দক্ষিণে দুটি সরু জানালা রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে সুন্দর কারুকার্যের তিনটি মেহরাব। মাঝখানের মেহরাবটি কিছুটা বড়। মেহরাবের বাঁ পাশে আছে তিন সিঁড়ির মেম্বর। তবে দেয়ালের যে অংশে পলেস্তারা এখনো খসে পড়েনি, সেখানে অপূর্ব কারুকার্যের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ১৫ ফুট এবং দেয়ালের পুরুত্ব প্রায় ৪ ফুট। ভূমি থেকে কার্নিশ পর্যন্ত উচ্চতা ১৫ ফুট। তবে কোনো নামলিপি না থাকায় মসজিদের নির্মাণ সাল নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এটি মোগল আমলে নির্মিত হয়।
দেবী চৌধুরাণী কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুস ছালাম বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘সংরক্ষণের অভাবে মসজিদটি অনেক আগেই জৌলুশ হারিয়েছে। তারপরও মসজিদটি দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটক আসেন। ফলে মসজিদটি সংস্কারের দাবি জানাচ্ছি।’
স্কুল শিক্ষক ফজলুর রহমান বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘পীরগাছায় এখনো কোনো পর্যটন এলাকা গড়ে ওঠেনি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্ব নিয়ে সুরক্ষার উদ্যোগ নিলে মসজিদটি একটি বড় নিদর্শন হবে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চন্ডিপুরের গোপন দুর্গ ভবনে নবাব নুরউদ্দিন বাকের জং, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরাণী ও শিবচন্দ্র রায় মাঝে মধ্যে গোপন সভা করে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের রণকৌশল নির্ধারণ করতেন। নবাব নুরু উদ্দিন বাকের জং ও দেবী চৌধুরাণীর গোপন দুর্গ ভবন থাকার কারণে চন্ডিপুরের জঙ্গলাকীর্ণ এ স্থানটির নামকরণ হয় পবিত্রকুটি বা পবিত্রঝাড়। ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির নেওয়া রাজস্ব নীতি অনুযায়ী বাংলার কৃষকদের থেকে কর আদায়ের জন্য ইজারাদারের লাইসেন্স-ধারক দেবী সিংহের অত্যাচার চরমে ওঠে।
লাফিয়ে লাফিয়ে কর বাড়ায় প্রথমে কৃষকরা অর্ধাহার, পরে অভুক্ত অবস্থায় মরতে শুরু করে। এ সময় অত্যাচারী দেবী সিংহের হাত থেকে নিজেদের ও প্রজাদের রক্ষার জন্য মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী চৌধুরাণী ও ইটাকুমারীর জমিদার শিব চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে ইংরেজ কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হয়। ইতিহাসে এ বিদ্রোহ ‘প্রজা বিদ্রোহ’ হিসেবে পরিচিত। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিত নাড়িয়ে দেওয়া মজনু শাহর নেতৃত্বে ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ আন্দোলনেও দেবী চৌধুরাণী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
চন্ডিপুর গ্রামের জঙ্গলাকীর্ণ গোপন ঘাঁটিতে ১৭৮৩ সালের বৈশাখ মাসের প্রথম সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিদ্রোহীদের গোপন আস্তানার সন্ধান পেয়ে আচমকা আক্রমণ শুরু করে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী। পীরগাছার মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী (দেবী চৌধুরাণী) আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এখানে নিহত হন। তার সঙ্গে নিহত হন ইটাকুমারীর মানব প্রেমিক জমিদার শিবচন্দ্র রায় এবং দেবী চৌধুরাণীর ছোট ভাই কেষ্ট কিশোর চৌধুরীসহ অসংখ্য প্রজা।
লড়াইয়ের মাঠের পাশে রয়েছে দেবী চৌধুরাণীর খননকৃত একটি বিরাট পুকুর। মাঠের মাঝখানে অবস্থিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি। ভারতের স্টার জলসা চ্যানেলে ‘দেবী চৌধুরাণী’ নামে যে সিরিয়ালটি (নাটক) দেখানো হচ্ছে, দুই বাংলাতে ব্যাপক জনপ্রিয় এই সিরিয়ালের মূল চরিত্রে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ‘দেবী চৌধুরাণী’কে নিয়ে রচিত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত।
প্রতি বছর বৈশাখ মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার এ স্থানে বসানো হয় নাপাই চন্ডির মেলা। কিন্তু কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে মেলাটির ঐতিহ্য। প্রভাবশালীদের কারণে মাঠের পরিধি ছোট হয়ে আসছে।
রংপুর প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর তাজহাট জমিদার বাড়ির কাস্টোডিয়ান হাসিবুল হাসান সুমি বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে বলেন, ‘পীরগাছার মোগল আমলের মসজিদটি এখনো প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে আমরা খোঁজ খবর নিয়ে তালিকাভুক্ত করার জন্য উপস্থাপন করব।’