মনপুরায় ধর্ষণ মামলা বাড়ছে, আসামি শিক্ষক-ছাত্রনেতারাও
ভোলার মনপুরায় বেড়েই চলছে ধর্ষণ মামলা। বেশিরভাগ মামলার ভিকটিম কলেজ ছাত্রী, স্কুল শিক্ষিকা ও দুর্গম চরাঞ্চলের গৃহবধূরা। আর আসামিদের তালিকায় আছেন- বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, ছাত্রলীগ নেতা, স্কুল শিক্ষক ও দুর্বৃত্তরা। ফলে বিষয়টি নিয়ে মনপুরার সাধারণ মানুষও চিন্তিত।
জানা গেছে, মনপুরা উপজেলায় গত তিন মাসে অন্তত ৮টি ধর্ষণ মামলা করা হয়েছে। এতে ৩০ জনকে আসামি করা হলেও গ্রেফতার হয়েছে মাত্র ৩ জন।
আরো জানা গেছে, গত ৭ সেপ্টেম্বর মনপুরা কলেজের এক ছাত্রী ওই কলেজের ছাত্রলীগ সভাপতি রাকিবকে আসামি করে ধর্ষণ মামলা করে। কিন্তু আসামিকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি।
এর আগে মনপুরা উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এনাম হাওলাদারের বিরুদ্ধে স্কুল শিক্ষিকাকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে এবং মামলাও হয়। পরে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু পুলিশ এখনো তাকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি।
গত ২৬ অক্টোবর মনপুরা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কর্মচারী নজরুল ইসলাম ও তার পাঁচ সহযোগী এক গৃহবধূকে স্পিডবোট থেকে চরপিয়ালে নিয়ে ধর্ষণ করে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর পুলিশ নজরুলকে গ্রেফতার করে। কিন্তু এখনো বাকি আসামিদের খোঁজ পায়নি পুলিশ।
গত ৪ নভেম্বর মনপুরার মাস্টারহাটের এক যুবতীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সোনার চরের রাকিব সওদাগর ধর্ষণ করে। পরে তাকে আসামি করে মামলা হলেও পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
গত ২৫ অক্টোবর মনপুরার কলাতলীর চরে এক মুক্তিযোদ্ধার নাতনিকে ধর্ষণ করে মো. বাবু নামের এক যুবক। পুলিশ তাকেও গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে স্থানীয়রা তাকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে।
সর্বশেষ মনপুরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণ মামলা হয়। কিন্তু পুলিশ এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে আদালতের নির্দেশে বর্তমান চেয়ারম্যান আমানত উল্যাহ আলমগীর ও স্কুল শিক্ষক ফারুক ফরাজীসহ ৮ জনকে আসামি করে মামলা হয়। এই মামলায়ও পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। মামলার বাদিকে পুলিশ মামলা প্রত্যাহার করার জন্য চাপ দেয় এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন ও গালমন্দ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগ আছে, এ ব্যাপারে মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাখাওয়াত হোসেন বাদীকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়োগ কিংবা অসদাচরণের কথা অস্বীকার করেন।
এদিকে, আসামিরা গ্রেফতার না হওয়া কিংবা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোর ঘটনায় সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে পড়েছেন। ধর্ষণ মামলার আসামি মনপুরা ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর নিজেই বলছেন, ধর্ষণ মামলার আসামিরা সবাই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পুলিশ বলছে কোনো মামলা তদন্তাধীন আছে, আবার কোনো মামলার আসামি পলাতক আছে।
তবে বর্তাটোয়েন্টিফোর.কম-এর এই প্রতিবেদক নিজে কয়েকজন ধর্ষণ মামলার আসামিদের সাথে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এমনকি একটি ধর্ষণ মামলার আসামি এনাম হাওলাদারের ভিডিও সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে- পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না, নাকি খুঁজছেই না?
দেখা গেছে, কলাতলী এবং কাজির চরের ধর্ষণ মামলার আসামি বর্তমান চেয়ারম্যান আলমগীর, সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন ও স্কুল শিক্ষক ফারুক ফরাজীসহ সবাই বহাল তবিয়তেই আছেন। কিন্তু পুলিশ আদালতের নির্দেশে মামলার এজহার নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- যদি মামলাগুলো মিথ্যাও হয়, তাহলে যারা মিথ্যা মামলা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না?
ধর্ষণ মামলার আসামি ও ছাত্রলীগ নেতা রাকিব বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, ‘আমার নামে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। মনপুরায় আরো অনেকের নামে এ ধরণের মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে। মূলত নোংরা রাজনীতির কারণেই এসব মামলা করা হচ্ছে।’
অপর একটি মামলার আসামি মনপুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলমগীর বলেন, ‘যে মহিলা আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে তাকে আমি কোনোদিন দেখি নাই, চিনিও না। ফলে ধর্ষণের প্রশ্নই উঠে না। অভিযোগকারী নিজেই এখন অনুতপ্ত। আগামী ১৮ নভেম্বর তিনি মামলা প্রত্যাহার করে নেবেন বলে জানতে পেরেছি। যে বা যারা আমার বিরুদ্ধে এ ধরণের মিথ্যা মামলা করিয়েছে আমি তাদের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করবো।’
একই মামলার আসামি কলাতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফারুক ফরাজী বলেন, ‘আমাদেরকে হয়রানি করতে রাজনৈতিকভাবে ধর্ষণ মামলা দেয়া হচ্ছে।’
মনপুরার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন হাওলাদার বলেন, ‘কাজীর চরের একটি মহল সাধারণ মানুষকে জমি বন্দোবস্ত দিবে বলে ব্যাপক হারে চাঁদাবাজি করেছে। আমি এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় আমার বিরুদ্ধে এ মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে ওই চক্রটি। এভাবে কেউ প্রভাবশালীদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তারা প্রতিবাদী মানুষকে দমন করতে মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।’
এ ব্যাপারে ভোলা বারের আইনজীবী নজরুল হক অনু বলেন, ‘সব মামলার অভিযোগ সত্য নয়। তবে মামলার অভিযোগ আদালতেই সত্য-মিথ্যার প্রমাণ হবে। কিন্তু পুলিশের ভূমিকা বেশ রহস্যজনক। এসব মামলার মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ ফায়দা লুটছে। আবার ভিলেজ পলিটিশিয়ানরা স্বার্থ হাসিল করছে। পুলিশ এবং ভিলেজ পলিটিশিয়ানদের মারপ্যাঁচে পড়ছেন অনেকে। এ অবস্থার সুষ্ঠু সমাধান হওয়া দরকার।’
এ বিষয়ে মনপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমি এ থানায় নতুন এসেছি। সব মামলার বিষয়ে এখনও বিস্তারিত জানি না। তবে কোর্ট থেকে যেসব মামলা এসেছে সেগুলো মিথ্যা এবং পলিটিক্যাল। তারপরও আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করবো। বাকিটা আদালত দেখবেন।’