বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে নির্যাতিত ৩ বন্ধুর খোঁজ রাখেনি কেউ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সেদিনের ভোরের আলো জানান দিয়েছিল আর বেঁচে নেই বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে হত্যার পরদিন রাতারাতি বদলে গেলো দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। সামরিক জান্তার ভয়ে আড়ালে চলে গেলেন আওয়ামী লীগের বহু নেতা। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোকে মুহ্যমান হয়ে নীরব হয়ে গেলেন।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে জীবন বাজি রেখে তাঁর হত্যার বিচার চেয়ে রাজপথে নামলেন নাটোরের গুরুদাসপুরের চাচকৈর এলাকার তিন ছাত্রলীগ কর্মী প্রবীর কুমার বর্মন, নির্মল কর্মকার ও অশোক কুমার পাল। হত্যাকাণ্ডের একদিন পর ১৭ আগস্ট তিন বন্ধু বিবেকের দংশনে এক হয় 'রক্তের বদলে রক্ত চাই, মুজিব হত্যার বিচার চাই' শ্লোগানটি নিজেরা হাতে লিখে পোস্টার আকারে গুরুদাসপুরের দেয়ালে দেয়ালে সাঁটিয়ে ও লিফলেট আকারে বিতরণ করলেন।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে এটিই ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলের প্রথম প্রতিবাদ। হত্যার বিচার চাওয়ায় 'বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা'র অভিযোগে ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ডসহ ২৯ মাস কারাভোগের পর ১৯৭৭ সালে মুক্তি পান তিন বন্ধু প্রবীর, নির্মল ও অশোক।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদকারী হিসেবে সরব ভূমিকার কারণে তিন জনের প্রত্যেকের পরিবারকে মূল্য দিতে হয়েছে পরবর্তীতে। ছাত্রাবস্থায় কারাবরণ, তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন ও নিজেদের জমি-ভিটেমাটি প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাওয়ায় আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি তিনজন। স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির রক্তচক্ষু মোকাবিলা করে কোনোরকমে টিকে ছিলেন তারা।
বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৩ বছর পার হলেও কারাবরণকারী নির্যাতিত ওই তিন বন্ধুর খোঁজ নেয়নি কেউ। সম্প্রতি বার্তা২৪.কমের সাথে সেই প্রতিবাদের দিন, দফায় দফায় নির্যাতন ও কারাবরণের স্মৃতি শেয়ার করেছেন তিন বন্ধু প্রবীর কুমার বর্মন, নির্মল কর্মকার ও অশোক কুমার পাল।
প্রবীর কুমার বর্মন বলেন, ‘১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর বিবেক আমাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। তাই আমরা হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে ১৭ আগস্ট রাস্তায় নামি, পোস্টারিং করি। ওই রাতে আমাদের গ্রেফতার করে গুরুদাসপুর থানার পুলিশ। পরদিন থানার তৎকালীন ওসি আনোয়ার হোসেন আমাদের নাটোর মহাকুমা আদালতে সোপর্দ করেন। আদালত প্রত্যেককে দুই বছরের ডিটেনশন দিয়ে সাবজেলে প্রেরণের নির্দেশ দেন। বয়সে তরুণ ও ছাত্রলীগের কর্মী হওয়ায় জেলখানায় আমাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। জেল পুলিশদের অসহনীয় নির্যাতনের কথা মনে পড়লে এখনও গা শিউরে ওঠে।
দুই বছরের ডিটেনশন শেষে সকলকে ৬ মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড ও দুইশ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা দিতে না পারায় আরও দুইমাসের কারাভোগ করতে হয়। জেল থেকে মুক্তির পর এক নিদারুণ কষ্টের জীবন শুরু হয়।
ছোট ভাইয়ের ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান চালিয়ে দুই মেয়ে কৃপা ও তৃষাকে এমএ পাশ করিয়েছি। তাদের চাকরি হয়নি। ছেলে প্রসেনজিৎ বিএ পড়ছে। স্ত্রী সন্ধ্যা বর্মন অসুস্থ। জীবন সায়াহ্নে এসে সংসারের খরচ জোগানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।'
অশোক কুমার পাল বলেন, 'গ্রেফতারের পর আমাদের প্রথমে নাটোর সাবজেল ও পরে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। নাটোর সাবজেলে না হলেও রাজশাহী কারাগারে নেয়ার পর আমাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। কারাগারে থাকা অবস্থায় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার জন্য আমাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। পরীক্ষা শেষে আবার কারাগারে নেওয়া হয়। দুই বছর ৬ মাস কারাভোগের পর নিরাপত্তার অভাবে আমি ভারতে চলে যাই। দশ বছর পর দেশে ফিরে আসি। তবে সংসারের হাল আর শক্ত করে ধরতে পারিনি। গান শিখিয়ে যা উপার্জন করেছি তাই মাস শেষে স্ত্রীর হাতে দিয়েছি।’
এভাবেই দুই মেয়ে মুনমুন ও অন্তরাকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। অন্তরা এমএ পাশ করলেও চাকরি জোটেনি কপালে।'
নির্মল কর্মকার বলেন, 'গ্রেফতারের পর কারাগারে সয়েছি নির্যাতন আর পরিবার সয়েছে কষ্ট। জেল থেকে মুক্তির পরও ভয়ে ভয়ে থেকেছি শুধু পরিবারের জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাওয়ায় আমার জীবনের সোনালী সময় আর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এটাই নিজের কাছে সান্ত্বনা যে আমরা চুপ করে বসে থাকিনি।'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ চেতনায় ধারণ করে এখনও প্রতীক্ষায় রয়েছেন তিন বন্ধু। নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর শহরের চাঁচকৈড় বাজারে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন তারা। সুখে-দুঃখে এখনও তারা একে অপরের খোঁজ রাখেন। তবে তাদের জীবন চলছে সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে। তবুও তারা মুখফুটে বলতে পারেন না কষ্টের কথা কারো কাছে। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট এলে তারা উপোষ থাকেন বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি কামনায়, প্রার্থনা করেন বঙ্গবন্ধুর জন্য। জীবন সায়াহ্নে এসে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িতদের বিচার দেখে মরতে চান।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক তিন বন্ধুর সাহসিকতার কাহিনী জানার পর গুরুদাসপুরের তরুণ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন তাদের সাহসিকতাপূর্ণ অবদানকে এবার থেকে যথাযথ মূল্যায়নের অঙ্গীকার করেছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তমাল হোসেন বলেন, জাতির পিতা হত্যার বিচার চেয়ে নির্যাতিত তিন বন্ধুর বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের যথাসম্ভব মর্যাদাদান ও সহায়তা করা হবে। বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় সৈনিকদের পরবর্তী প্রজন্ম যেন ভুলে না যায় সেজন্যও আগামীতে বিভিন্ন আয়োজনে সম্মানের সাথে তাদের উপস্থিতির জন্য অনুরোধ করা হবে।